বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪–এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল এক দশকে (২০১৩–২০২৪) দেশে নতুন কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৬২ লাখ ৬০ হাজার ১৮৪। অথচ এর আগের দশকে (২০০৩–২০১৩) এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ। অর্থাৎ, আগের দশকের তুলনায় কর্মসংস্থান ৭০ লাখের বেশি কমেছে। ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অডিটরিয়ামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে দেশের শিল্প খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিন কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জন নিয়োজিত ছিলেন। ২০১৩ সালে কর্মসংস্থানে যুক্ত ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ ৮৫০ জন। সেই হিসাবে গত এক দশকে নতুন কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৬২ লাখ ৬০ হাজার ১৮৪ জন। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সৃষ্ট নতুন কর্মসংস্থানের তুলনায় ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ৮১৬ জন কম। ওই দশকে কর্মসংস্থান বেড়েছিল এক কোটি ৩৩ লাখ জন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত কাজে নিয়োজিত তিন কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জনের মধ্যে পুরুষ দুই কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ২৯৮ জন। মহিলা ৫১ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৭ জন, হিজড়া দুই হাজার ৫৯ জন। শিল্প খাতে গত এক দশকে এক লাখ ১৬ হাজার ৯৭৮টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদনশীল খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়াই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ধীরগতির অন্যতম কারণ। শিল্প খাতে কর্মসংস্থান আশানুরূপ না বাড়লেও, সেবা খাত এখন অর্থনীতির ৯১ শতাংশ দখল করে আছে।
এদিকে, নারীর কর্মসংস্থানও আগের তুলনায় কমেছে। ২০১৩ সালে কর্মসংস্থানে নারীর সংখ্যা বেশি থাকলেও ২০২৪ সালে তা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার ফলে দেশের শ্রমবাজারে নতুন সংকট দেখা দিতে পারে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘গ্রাম ও শহরে উদ্যোক্তার অভাব নেই। এত উদ্যোক্তা যে চারদিকে দেখি শুধু উদ্যোক্তা। মনে হয় বাংলাদেশ উদ্যোক্তাদের দেশ। কিন্তু উদ্যোক্তাদের মূলধন নেই।’ তিনি বলেন, ‘দেশের উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করলে অনেক কর্মসংস্থান হবে। এদের ঋণ ও টাকা দেওয়া হয় না। অথচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়েছে। ব্যাংকও খালি হয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে এসব টাকা চলে গেছে।’
বিশ্লেষকরা বলেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত বেশ কিছু বিষয়ে অভিযোগ ছিল এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা, বিরোধী মত দমন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যর্থতা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট, তীব্র বেকারত্ব রোধে ব্যবস্থা নিতে না পারা, নিয়োগ–বাণিজ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস এবং শিক্ষিত বেকারদের তীব্র হতাশা এবং সে বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে বেগবান করেছিল। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে বিদ্যমান অন্যান্য নেতিবাচক অর্থনীতির সূচকগুলোর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশ থেকে বেকারত্বের তীব্রতা কমানোর জন্য জরুরি কর্মসূচি গ্রহণ করা।
বলা বাহুল্য, দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক–তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরিও আবশ্যক। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে যুব সমপ্রদায়ের ভাগ্যোন্নয়ন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।