বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন সংস্থার সামপ্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা। এজন্য দিন দিন শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার আশঙ্কাজনক। ফলে সম্ভাবনাময় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে হতাশা এবং দেশ বঞ্চিত হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতির সুবিধা থেকে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে ৫৭টি (২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ২০২১ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে। তবে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করছেন প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার জন। এর মধ্যে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যয়ন করছেন ১ লাখ ২৯ হাজার শিক্ষার্থী। এসব সরকারি–বেসরকারি, অধিভুক্ত, অঙ্গীভূত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হয়। কিন্তু তাদের সেই শিক্ষা কতটা বাস্তব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার মান বাড়িয়ে বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করার এখনই সময়।
এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফাকে. মুজেরীর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে উল্লিখিত পত্রিকায়। তিনি বলেন, শিক্ষিত ও তরুণ বেকার বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা যারা শিক্ষিত তারা যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তারা চান প্রাতিষ্ঠানিক কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এখানে বেতন ও সুযোগ–সুবিধা কম। ফলে তারা বেকার থাকছেন। দেশের শিক্ষাকর্মের বাজারের চাহিদা উপযোগী নয়। ফলে এখানে একটা মিস ম্যাচ আছে। কিন্তু শিক্ষার হার বাড়ছে, ফলে শিক্ষিত বেকার বাড়তেই থাকবে। এজন্য শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করা দরকার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা তো ব্যক্তিগতভাবে অনেক খরচ করছে। আবার তাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আছে। যখন এসব শিক্ষার্থী বেকার থাকছে তখন উভয় বিনিয়োগই অপচয় হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা এ দেশে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেগুলো বাস্তবতা কিংবা কর্মের সঙ্গে সংযোগ নেই। শিক্ষিত বেকার সংখ্যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার তিন বছর পরও শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ বেকার থাকছেন।
দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক–তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরিও আবশ্যক। দেশে প্রতিবছর নতুন নতুন যে জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে তাদের যথাযথভাবে কর্মদক্ষ করে কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যৎ নতুন বাংলাদশে বিনির্মাণে নবতর অধ্যায় রচিত হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে যুব সমপ্রদায়ের ভাগ্যোন্নয়ন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ অন্যান্য খাত সংস্কারের মতো এই ক্ষেত্রেও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া না হলে কর্মসংস্থান সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে।