কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

| মঙ্গলবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

রাজধানীর অনুষ্ঠিত ‘চতুর্থ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৫’এ দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর যে বিপুলসংখ্যক নতুন শ্রমশক্তি যুক্ত হয়, তাদের বড় একটি অংশকেই কর্মহীন থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। এমন বাস্তবতায় আগামী দিনের বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ‘অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অংশ নেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যাংকার, আমলা, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ সম্মেলনে অংশ নেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীর বাংলাদেশে বেকারত্ব সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে বেকারত্বের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করেছে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের অভাবে ছোটবড় সব শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা ও মোটরবাইক রাইডারদের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরের বস্তিগুলোয় বাড়ছে মানুষের চাপ। বেঁচে থাকার তাগিদে বা একটু বেশি আয়ের আশায় মানুষ গ্রাম থেকে ছুটে এসেছে নগরে। এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা রাজধানী ঢাকার। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্ট ২০২৫ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার পর ঢাকা এখন ৩ দশমিক ৬৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল মহানগরে পরিণত হয়েছে। ধারণক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত জনবসতির কারণে ঢাকার পরিবেশ বহু আগেই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন যানজট। প্রতিদিন বিনষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০২২এর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে কর্মজীবীদের ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ বা ছয় কোটি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় কর্মক্ষম মানুষ বাধ্য হয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে শ্রম দিচ্ছেন। শ্রমের বিনিময়ে তারা কেউ ধনী হয়েছেন এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই, কেবল টিকে থাকার লড়াইয়ে তারা নিমগ্ন। শহরাঞ্চলের অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবীদের একটি বিশাল অংশ বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করেন। আরেকটি অংশ ফুটপাত, রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড বা মার্কেটের বারান্দায় ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন করেন। তিনবেলা খাবার জোগানোই তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। নগরমুখী অভিবাসীর এ বিশাল জনগোষ্ঠী পরিবেশ দূষণ, যানজট, পানি ও বিদ্যুতের ওপর চাপসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রীকরণ না করে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নের কুফল নগরবাসীকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে। এদিকে পরিকল্পনার অভাব, দারিদ্র্য, অদক্ষতা, পশ্চাদপদ শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে দেশের বেকার সমস্যা বাড়ছে। বেকারত্ব সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় ২০২৪ সালে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় নয় লাখ। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উচ্চশিক্ষিত বেকাররাই সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমত কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষার মানের বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে। যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দিচ্ছে, তা কর্মবাজারের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ স্নাতক হয়েও এমন দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না, যা দিয়ে তাঁরা চাকরি পেতে পারেন। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানের দিক থেকে অঞ্চলভেদে ব্যাপক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। তাঁরা বলেন, আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর উপায় হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান বাড়ানো। আর এ জন্য প্রয়োজন নতুন বিনিয়োগ। বিনিয়োগের মাধ্যমে যেমন ব্যবসা ও শিল্প গড়ে ওঠে, তেমনি কাজের সুযোগও তৈরি হয়। তাতে মানুষের ভোগ বাড়ে, গতি আসে অর্থনীতিতে। তাই আগামীতে কর্মসংস্থান তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (অ্যাডজান্ট ফ্যাকাল্টি) . শায়খ আহমদ এক প্রবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশে জুলাই২৪ পরবর্তী সময়ে মানুষের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক। নির্বাচনকালীন ও নির্বাচনপরবর্তী সময়ে মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে মিল না হলে রাজনৈতিক দলগুলো জনরোষের শিকার হবেন। অন্যদিকে দেশব্যাপী ও প্রবাসের মাটিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিচিত্র বদলে যাবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো যত বেশি বাস্তবনির্ভর কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেবেন, তত বেশি ভোটার আকৃষ্ট করতে পারবেন। নবীন ভোটারদের কাছে কর্মসংস্থান এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এজন্য কর্মসংস্থান হবে আগামী নির্বাচনের অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমেই অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা অঙ্কিত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে