সমপ্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , বাংলাদেশে উৎপাদন খাতে আরও বেশি সংখ্যক নারী কাজ পেলে উৎপাদন ২১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ ছাড়াও লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে পারলে সেবা খাতে লাভের সম্ভাবনা রয়েছে আরও ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বেশি হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই দেশে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হবে। তবে পোশাক শিল্পে অগ্রগতি সত্ত্বেও বৃহত্তর উৎপাদন খাতে নারী–পুরুষের ব্যবধান অনেক বেশি বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ ও ২০২৩ সালে বাংলাদেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৭ শতাংশেই স্থির হয়ে আছে। সরবরাহের সীমাবদ্ধতা, নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও রক্ষণশীল সামাজিক রীতিনীতিকে আরও বেশি নারীর কাজে যোগ দেওয়ার পেছনে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে যদি আরও বেশি সংখ্যক নারী কৃষি খাতে যোগ দেন, তবে শ্রম উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মস্থলে লিঙ্গবৈষম্য কমবে। লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে পারলে সেবা খাতে লাভের সম্ভাবনা ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশে নারী সুরক্ষা আইন দুর্বল। ফলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সমাজ নারীদের প্রতি সবচেয়ে রক্ষণশীল। প্রতিবেদন অনুসারে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার সবচেয়ে নিচের দিকে। পুরুষের হারের তুলনায় অনেক কম।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিসকা ওনসোর্গ বলেন, ‘উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর গড় ৫৪ শতাংশের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩২ শতাংশের অনেক কম।‘ তিনি বলেন, ‘নারীর কর্মসংস্থান বাড়াতে সব পক্ষের উদ্যোগ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি খাত, সমাজ ও পরিবারের ভূমিকা আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ৮ কোটি ২২ লাখ নারীর ১৬ কোটি ৪৪ লাখ হাতকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব। তাঁরা মনে করেন, নানাভাবে নারী সমাজকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের অধিকার ও জ্ঞান অর্জন থেকে। কিন্তু বোঝা উচিত যে, নারীর পিছিয়ে থাকা মানে জাতির অগ্রগতি রোধ করা। নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ও বৈষম্য সৃষ্টি করে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্ন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নারীরা এগিয়ে থাকার কারণ হলো তাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়, সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য নেই। আইনের রয়েছে যথার্থ প্রয়োগ। রাস্তায়–পার্কে, বাজার–বন্দর, বাস–ট্রেন, অফিস–আদালত সর্বক্ষেত্রে রয়েছে তাদের পদচারণা, কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। রয়েছে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। দিন রাত সমানতালে এগিয়ে চলছেন নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ ও জাতি গঠনের কাজে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের ধ্যান–ধারণার তেমন পরিবর্তন হয়নি। যদিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু নানা ধাপে নেতৃত্ব দিয়েছে নারীরাই।এখনও সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে নারীদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর কুসংস্কারে ডুবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে নারী শিক্ষার উন্নয়ন একটি অন্যটির পরিপূরক।
একমাত্র শিক্ষাই যেমন পারে নারীকে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে, তেমনি নারীরাই পারে সুশিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। নারীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে সরকার সচেষ্ট। এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এর ফলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। কেননা কর্মসংস্থানই নারীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে। আর যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও নারীরা বর্তমানে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখছে এবং সুশিক্ষিত হয়ে উপার্জনে অংশ নিচ্ছে, তাদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তর। তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, ব্যাংকার, পুলিশসহ সব স্বনামধন্য পেশাতে যুক্ত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষকতা পেশায়ও এগিয়ে তারা। তবু আমরা বলি, আরো উন্নয়ন চাই। তাদের অগ্রগতি মানে জাতির অগ্রগতি। দেশের স্বার্থেই নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।