জীবন ধারণের জন্য মানুষের অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের অর্থের সংস্থান হয় চাকরির মাধ্যমে। চাকরিজীবী মানুষের জীবনের একটা বড় সময় অতিবাহিত হয় তার কর্মস্থলে। আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুসারে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে একজন চাকরিজীবী মানুষকে দিনের ৮ ঘণ্টা তথা এক তৃতীয়াংশ সময় তার কর্মস্থলে কাটাতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র আরেকটু ভিন্ন। এখানে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষদেরকে দৈনিক কমপক্ষে ১২ ঘন্টা কিংবা তারও বেশি সময় কাজ করতে হয়। সে হিসাবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় আমাদের দেশে একজন শ্রমজীবী মানুষের দিনের অর্ধেক সময় কাটে তার কর্মস্থলে। তাই কর্মস্থলের পরিবেশের সাথে একজন শ্রমজীবী তথা শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কর্মস্থলের পরিবেশ খারাপ হলে তাতে শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। শ্রমিকের কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়। যা প্রকারান্তরে উৎপাদন ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই কর্মস্থলের পরিবেশ ভাল রাখা প্রত্যেক নিয়োগকর্তা বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অন্যতম দায়িত্ব বলেই আমি মনে করি। এখানে ভাল পরিবেশ বলতে কেবল অবকাঠামোগত পরিবেশকে বুঝাচ্ছি না। আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, কোন প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত পরিবেশের পাশাপাশি কর্মরত সবার সম্মানজনক অবস্থান এবং পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক, পারস্পরিক আচার-আচারণ, শ্রদ্ধাবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু মিলেই উক্ত প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ তৈরি হয়। একে প্রতিষ্ঠানের সামাজিক পরিবেশও বলা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে সামাজিক পরিবেশ একটি প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্যতম অপরিহার্য উপাদানও বটে। বাংলাদেশে রপ্তানিমুখি পোশাক কারখানাগুলোতে বৈদেশিক বায়ারদের যে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স অডিট হয় তাতে মূলত প্রতিষ্ঠানের সামাজিক পরিবেশের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
কর্মক্ষেত্রের সামাজিক পরিবেশ বিশ্বব্যাপী এখন অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। সেই লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২১ জুন জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৮ তম অধিবেশনে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি নিরসনকল্পে একটি কনভেনশন গৃহিত হয়।
কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি হচ্ছে মূলত সে সকল অগ্রহণযোগ্য ব্যবহার ও চর্চা অথবা হুমকি যেগুলো এক বা একাধিকবার সংঘটিত হওয়ার ফলে একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক, যৌন অথবা অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয় এবং যা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও হয়রানির অন্তর্ভুক্ত।
কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা বা হয়রানীর প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারীকে যৌন হয়রানি বা নির্যাতন করা। এধরনের হয়রানির শিকার নারীরা বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। নারীর সাথে অশোভন কথা বলে, বিভিন্ন যৌন সুড়সুড়িমূলক ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে, গায়ে হাত দিয়ে, দৃষ্টিকটুভাবে নারীর দিকে তাকিয়ে থেকে, মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে যৌন হয়রানি করা হয় বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ পাওয়া যায়। এধরনের কার্যকলাপের শিকার বেশির ভাগ নারী চাকরি হারানোর ভয়ে কিংবা লজ্জাবোধ অথবা অভিযোগ করলে উল্টো ফেঁসে যাবার আশংকার কারণে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকে এবং বছরের পর বছর নীরবে সহ্য করে যায়।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী জানুয়ারি ‘২০ থেকে সেপ্টেম্বর ‘২০ পর্যন্ত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া ১৬১ নারীর মধ্যে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারী এবং ৯ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। ১০ জুন ‘২০ তারিখে একটি জাতীয় অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ২০২০ সালে মে মাসে কর্মক্ষেত্রে ৬৭টি শিশু নির্যাতন, ১৯টি ধর্ষণ, ১২টি ধর্ষণ চেষ্টা, ১৯টি হত্যা এবং ২১ জন শিশুকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। বাস্তব চিত্র এরচেয়েও ভয়াবহ।
কর্মক্ষত্রে সহিংসতা বলতে আমরা বুঝি মূলত যৌন হয়রানি বা নির্যাতন। যৌন হয়রানি বা নির্যাতন প্রতিরোধ করা গেলে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা অনেকাংশে লোপ পেত বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। যৌন হয়রানি বা নির্যাতন প্রধানত নারীর উপর সংঘটিত হলেও শিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কর্মক্ষত্রে সহিংসতা তথা যৌন নির্যাতন দুর্বলের উপর সবলের নিপীড়ন এবং এটা এক ধরনের বিকৃত কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৩৩২ ধারায় বর্ণিত আছে “কোন প্রতিষ্ঠানের কোন কাজে কোন মহিলা নিযুক্ত থাকলে, তিনি যে পদমর্যাদারই হোন না কেন, তার প্রতি উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ এমন কোন আচরণ করতে পারবেন না যা অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত বলে গণ্য হতে পারে, কিংবা যা উক্ত মহিলার শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী”৷ শ্রম আইনের এই ধারাটি কর্মক্ষেত্রে নারীর উপর সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তবে আইনটি আরো একটু বিস্তৃত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি এই আইন কার্যকর করতে হলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আরো দায়িত্বশীল সক্রিয় ভূমিকাও প্রত্যাশিত।
আইএলও কনভেনশন ১৯০তে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিহত করতে এবং নিরসনকল্পে বিশ্বের সকল দেশে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, যৌথ দরকষাকষির অধিকার এর কার্যকর স্বিকৃতীর কথা বলা হয়েছে এবং সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক বা বাধ্যতামূলক কাজের অবসান, শিশুশ্রমের কার্যকরভাবে অবসান এবং পদমর্যাদার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বন্ধ করে শোভন কাজ নিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সংগঠন করার অধিকার এবং দরকষাকষির অধিকারের কথা আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ তেও উল্লেখ আছে। আবার আমাদের জাতীয় সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদেও স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শ্রম আইনের ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ অধ্যায় রচিত হয়েছে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, যৌথ দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে শ্রমিকেরা সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বার বার প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে।
শ্রম আইনের ১৭৯(২) ধারায় উল্লেখ আছে “শ্রমিকগণের কোন ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রিকরণের অধিকারী হবে না, যদি না যে প্রতিষ্ঠানে উহা গঠিত হয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত শ্রমিকগণের মোট সংখ্যার অন্যুন শতকরা বিশভাগ শ্রমিক উক্ত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হন” এই ধারাটি শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে আমি মনে করি। কারণ কোন প্রতিষ্ঠানে একটি ইউনিয়নও যদি না থাকে সেখানে প্রথম ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে যে বা যারা ইউনিয়ন গঠন করতে চাই তাদের প্রত্যেকের ইউনিয়ন করার অধিকার থাকা উচিত। অর্থাৎ কোন প্রতিষ্ঠানে প্রথম ইউনিয়ন গঠন করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের কমপক্ষে ২০% অন্তর্ভুক্তির শর্ত হিসাবে ১৭৯(২) ধারাটি বাতিল হওয়া জরুরি।
একটি প্রতিষ্ঠানে কিংবা সেক্টরে মালিক, শ্রমিক এবং রাষ্ট্র তিন পক্ষ মিলেই শিল্প সম্পর্ক তৈরি হয়। তিন পক্ষের অবস্থান ভারসাম্যপূর্ণ না হলে সুস্থ ধারার শিল্প সম্পর্ক ব্যাহত হয়। তাই শিল্পের সকল পক্ষের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ও সুস্থ ধারার শিল্প সম্পর্ক রক্ষার্থে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের কোন বিকল্প নাই। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত হলে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যমুলক আচরণ, সহিংসতা বন্ধ করা সহ আরো অন্যান্য বিদ্যমান সংকট সমূহও অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হতো। তাই আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এবং আমাদের দেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে শ্রমজীবী মানুষের স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার তথা অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি