কর্নেল জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম : নির্মোহ এক স্বপ্নযোদ্ধা

জিয়া হাবীব আহসান | শুক্রবার , ১৫ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)র সাবেক সফল চেয়ারম্যান (১৯৯৩৯৬), প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশন্যাল স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ কর্ণেল (অবঃ) জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম) গত ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি আমার পরিবারের সকলের ঘনিষ্ঠজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আমার সহধর্মিণী মিসেস আশফা খানম তাঁর অধীনে প্রেসিডেন্সী ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে (২০০১২০০৭) দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। আমার বড় সন্তান রাইসা ও ২য় সন্তান ফুয়াদ আহসান তাঁর সুযোগ্য স্টুডেন্টস ছিল। তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের জন্য সকল প্রেরণার উৎস। তিনি প্রায়শই নানা আইনী বিষয় নিয়ে আমার সাথে পরামর্শ করতেন। আল্লাহ্‌ পাক এ নিখাদ নির্লোভ দেশপ্রেমিক, আদর্শচরিত্রবান ও ধার্মিক মানুষটিকে ক্ষমা করে দিন, নেক আমল সমূহ কবুল ফরমান, আমিন। রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির প্রতিবাদে প্রেসক্লাবের সামনে প্লেকার্ড নিয়ে একক প্রতিবাদ তাঁর বিবেকবোধ ও সৎসাহসের পরিচায়ক। এধরনের নিখাদ নির্লোভ দেশপ্রেমিক আদর্শ চরিত্রবান মানুষের বর্তমানে বড়ই সংকট চলছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বীর উত্তম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেনানায়ক (জেড ফোর্সএর সহ পরিচালক) এবং পরবর্তীতে একজন বামপন্থী বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত। মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর কক্সবাজারের চকরিয়ার পহরচান্দা ইউনিয়নের হারবাং গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মরহুম মোঃ কাসেম এবং মাতা মরহুমা বেগম মজিদা খাতুন। পাকিস্তানের সারগোদার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাবলিক স্কুলে সেকেন্ড এন্ট্রিতে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ (এইচএসসি) সমাপ্ত করে মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ২৫তম পি.এম.. লং কোর্সে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের জন্য তিনি বিশেষ সম্মাননা পেয়েছিলেন। পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এডিসি এবং পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী এবং সমাজের শ্রেণি বৈষম্য, দারিদ্রতা, শোষণনির্যাতনের প্রতি বিদ্রোহী মনোভাব পূর্ণ। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা স্বদেশী মানুষের বন্দিদশার মুক্তিকল্পে স্বপ্ন দেখতেন একটি সুশীল রাষ্ট্রের, স্বাধীন বাংলার। তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্স পাবলিক স্কুল, সারগোদা, পাঞ্জাব, থেকে সিনিয়র ক্যামব্রিজ সম্পন্ন করেন ১৯৫৮ সালে। তারপর চিটাগাং কলেজে ভর্তি হন। নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খল জীবনের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। তাই তিনি চিটাগাং কলেজে থাকাকালীন ১৯৫৯ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৯৬২ সালে কমিশন লাভ করেন। তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকোল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্বের সীমা চরম পর্যায়ে। সারাদেশে যুদ্ধের একটা পূর্বাভাস বইছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতভাবে নিরীহ বাঙালিদের উপর গণহত্যা শুরু করে। স্বদেশের মানুষ ও বৈরী শত্রুদের হাত থেকে দেশমাতাকে রক্ষা কারার জন্য সারাদেশে শুরু হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম। মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তাকেই টানে মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে মৃত্যু জীবনের অপ্রেতিরোধ্য ছায়া অনুচর। ভীরুতা ও কর্তব্যত্যাগী নয়, মরণজয়ী সাহসী আত্মপ্রত্যয়ই জীবনের যথার্থ ধর্ম। এই বৈশিষ্ট্য জীবনকে করে তুলে সার্থক, তাকে দেয় মহিমানন্বিত ঐশ্বর্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টারে। সারাদেশে মৃত্যুর কলঙ্কময় প্রতিচ্ছবি দেখে স্বদেশী বিয়োগান্ত হত্যার বিদ্রোহে ১৯৭১ সালে জুনের দিকে রাউয়ালপিন্ডি থেকে তিনি (জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম) কর্ণেল তাহের, জেনারেল মনজু, কর্ণেল পাটোয়ারীসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং ২৭ জুলাই এই দলটি দিল্লি পৌঁছায়। ৭ আগস্ট কলকাতায় পৌঁছান মেজর জিয়াউদ্দিনসহ বাকিরা। এরপর তাকে জেড ফোর্সের অধীনে থাকা প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সংগ্রামে যোগ দেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর মেজর জিয়াউদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক পাকিস্তানি বাহিনীকে কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের করতে হবে। প্রতিবার মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের পরপরই বেপরোয়া হয়ে উঠত পাকিস্তানি বাহিনী। এর আগে ৩১ জুলাই কামালপুরের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তৎকালীন সামরিক বাহিনীতে যে ভোগ বিলাস তা দেশমাতার ক্রান্তিলগ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লোভের মোহ সৃষ্টি করতে পারেনি। মৃত্যুকে সাহসের অভিজ্ঞানে ঠেলে ছুটে এসেছেন মাতৃভূমির স্বদেশবাসীর মুক্তি কামনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জিফোর্স এ ছিলেন। ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। তার কর্তৃত্বাধীনে ৮০০ জন নিয়ন্ত্রিত সৈন্য ছিল এবং তিনি তখন মেজর পদমর্যাদার অধিষ্ঠিত ছিলেন। যুদ্ধে অসমান্য কৃতিত্বের জন্য তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করেন বাংলাদেশে সরকার। তার সনদ নম্বর ২০। চকরিয়ার এই মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের যুগসন্ধিক্ষণে বীরত্বের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন তার হয়ত সামান্যই আমরা উল্লেখ করেছি তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে। ১৯৭২ সালে তিনি সরকার ও ভারতের সঙ্গে চুক্তির সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার ফলে তাকে সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৬ বছর পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। এর পর তিনি ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শে জীবন অতিবাহিত করেন। জিয়াউদ্দিনের জীবনী নিয়ে এ কে এম মহসীন রচিত নির্মোহ এক স্বপ্নযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) জিয়াউদ্দিনের (বীর উত্তম) জীবন কথাবইটি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তার মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক জীবনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনকে ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে লেফট্যানেন্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিন তাকে গার্ড অফ অনার দেন। তিনি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর ১টি মাত্র মেয়ে, আইউবি থেকে লেখাপড়া শেষে স্বামীসহ অস্ট্রেলিয়া নিবাসী এবং তিনি (জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামে বসবাসরত ছিলেন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থেকে লিখেছেন কিছু প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও ঐতিহাসিক বিবরণ যেগুলো একদিকে যেমন সময়ের সাক্ষ্য হয়ে আছে, অন্যদিকে পাঠকদের জন্য এক উজ্জ্বল বুদ্ধিবৃত্তিক অনুধ্যানের জানালা খুলে দেয়। তাঁর লেখনীতে ছিল শুদ্ধতা, আত্মবিশ্বাস ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি। কাগজের পাতায় বা সংবাদের ফাঁকে, মাঝে মাঝে ফুটে উঠত তাঁর অন্তর্লীন দেশপ্রেম, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তিনি কখনো অস্বীকার করেননি। বরং তরুণ প্রজন্মের মাঝে মাঝে সঙ্গে মতবিনিময় করতেন, ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতেন নতুন প্রজন্ম যেন ভুলে না যায় কোন মাটির জন্য কত ত্যাগ দিতে হয়েছে। তাঁর এ অনাড়ম্বর চেতনা ও আদর্শ ছিল আরও বলিষ্ঠ, আরও গভীর। মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামী আদর্শকে তিনি পরিপূরক মনে করেন। তাঁর সততা ছিল জীবনের প্রতিটি স্তরে চিন্তায়, কথায় ও কর্মে। সৎ জীবনযাপন, অনুশাসনের প্রতি দৃঢ়তা, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার যে মানসিকতা, তাই তাঁকে করে তুলেছিল একজন আদর্শবাদী ও অনন্য দেশপ্রেমিক। এ ধরনের মানুষ সমাজে বিরল, যাঁরা নিভৃত থেকে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন, উচ্চারণ নয়, অবস্থানে জানান দেন। দীর্ঘ সময় একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আত্মগোপনে থাকলেও, ১৯৯০এর দশকে সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় তিনি আবার সমাজ জীবনে স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসেন। তবে প্রচারবিমুখতা ও আত্মমর্যাদাবোধের কারণে নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রে আনেননি কখনো। আশকার দিঘির পাড়ে তাঁর চট্টগ্রামের বাসাটি হয়ে ওঠে এক নির্জন আশ্রয়স্থল, যেখানে বই, চিন্তা, স্মৃতি এবং সীমিত কিছু ঘনিষ্ঠজনের সাহচর্যেই তিনি অতিবাহিত করেন তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়। আমৃত্যু তিনি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রসিডেন্সী ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ প্রান্তে কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। তবুও তিনি ছিলেন মানসিকভাবে দৃঢ় ও আত্মিকভাবে প্রশান্ত। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়েও তিনি ছিলেন পরিপূর্ণভাবে এক সজ্জন, আত্মবিশ্বাসী ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, যাঁর সমগ্র জীবন এক প্রেরণার নাম হয়ে রইল।

লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী। মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রত্যেক ফরজ নামাজের পর রাসুলুল্লাহর (সা.)-প্রয়োজনীয় আমল
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা