২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর। চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা থেকে রাত সাড়ে ৩টার সময় প্রশাসনের লোক পরিচয়ে হঠাৎ বাসা থেকে মো. জাহিদ হাছান (১৮) কে তুলে নিয়ে যাওযার অভিযোগ সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে।
সে দিন তুলে নিয়ে তাঁকে গুম হবার পর থেকে শোকে কাতর তাঁর মা ও পরিবার। তাঁরা জানেন না আসলে জাহিদের সঙ্গে কী ঘটেছে সেদিন। এখনো বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। ঘুমের ৬ বছর পরও অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি মা হোসনে আরা বেগমের।
সম্প্রতি, স্বৈরাচার সরকারের বিদায়ের পর অনেকেই গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন। তাঁর মায়েরও আশা, হয়তো তিনিও ফিরে আসবেন। কথা হয় হোসনে আরার সঙ্গে। তিনি দৈনিক আজাদী অনলাইনকে জানান, তাঁর ছেলে জাহিদ গুম হওয়ার গল্প এবং পরিবার নিয়ে তাঁর নিদারুণ কষ্টের কথা।
মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘কোথায় আছে তাঁর ছেলে জাহিদ? আদৌ ফিরবে কি-না আমরা কিছুই জানি না। তবে আমরা বিশ্বাস করি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে সে। নিখোঁজের পর থেকে হন্যে হয়ে তাঁকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। ২০ বারের অধিক র্যাবের কাছে গেছি, থানা পুলিশ, ডিবি অফিসসহ বারবার সবার দ্বারস্থ হয়েছি, কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি জাহিদের।
ওই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর খালার বাড়ি থেকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে তুলে নেওয়া নেওয়া হয় মো. জাহিদ হাছান (১৮) কে। কিন্তু ৬ বছরেও সন্ধান মেলেনি আর। প্রতিদিন ছেলে ফিরে আসার আশায় ঘরের দরজা খুলে রাখেন মা। কিন্তু রাত্রি শেষ হয় কিন্তু আদরের ছেলে জাহিদ ফেরার সময় শেষ হয় না।’
ঘটনা বিবরণে জানান, গত ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর রাত আনুমানিক ৩টা ৩০ মিনিটের সময় তাঁকে ধরে কালো মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। এ ব্যাপারে স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও তখন কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
এ ঘটনার দুই দিন পর পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজের বড় ভাই মো. মেহেদী হাসান বিপ্লব প্রকাশ জনি বাদী হয়ে কর্ণফুলী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী (যার নং-৭২০) করেন। তখন ওসি ছিলেন মোহাম্মদ আলমগীর। তাঁকেও বারবার বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেননি কারা তাঁর থানা অধিক্ষেত্র থেকে এভাবে রাতের আঁধারে যুবককে তুলে নিলেন।
জিডি সূত্রে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিচয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের উত্তর চরলক্ষ্যা গ্রামের হোসনে আরা বেগমের স্বামী মৃত মো. ইয়াছিনের ছেলে (নিখোঁজ) মো. জাহিদ হাছান ছিলেন একজন ড্রাইভার।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নগরীর এক ব্যবসায়ী অসীম রায় বাবুর প্রাইভেট কার চালাতেন জাহিদ। রেয়াজ উদ্দিন বাজার কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত ছিলো এই অসীম। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে যুবলীগ নেতা বাবর ও অসীমের সম্পর্কে ফাটল ধরে। বাবরের মত অসীমও অস্ত্রধারীর তালিকায় ছিলো পুলিশের খাতায়৷
২০১৮ সালের ১২ই অক্টোবর চট্টগ্রামের মুরাদপুরে র্যাবের কথিত বন্দুক যুদ্ধে প্রাণ হারান অসীম। অসীমের গুলিতেও তখন আহত হন দুই সিনিয়র অফিসারসহ র্যাবের ৪ জন। পুরো বন্দুক যুদ্ধের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো অসীমের ড্রাইভার জাহিদ হাছান৷ সেই ঘটনার পরে স্থানীয় সিপ্লাস টিভি এবং সময় টিভিতে বক্তব্য দিয়েছিলেন জাহিদ। এর দুইদিন পর তাঁকে সাদা পোশাকে কর্ণফুলী থেকে তুলে নিয়ে যায় প্রশাসন পরিচয়ে লোকজন। পরিবারের অভিযোগ র্যাব সাদা পোশাকে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো।
এ ঘটনা জানাতে গিয়ে নিখোঁজের মা হোসনে আরা বেগম ও জাহিদের বড় ভাই মো. মেহেদী হাসান বিপ্লব জানান, ‘৬ বছর আগে দুইটি কালো ও সাদা মাইক্রোবাস নিয়ে ৮ থেকে ১০ জন লোক খালার বাড়িতে গিয়ে জাহিদকে ডেকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা প্রশাসনের লোক বলে পরিচয় দেয়। তাদের সবাই গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট পরা ছিল। কোমরে অস্ত্র ছিলো। কারো কোন মুখোঁশ পরা ছিলো না।’
তাঁরা আরও জানান, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে বারবার পরিচয় জানতে চাওয়া হয় কিন্তু প্রশাসনের লোক বলে হুমকি দমকি ছাড়া ওই সময় তাঁরা আর কিছু জানায়নি বলে তথ্য দেন।
গাড়ি ছিলো দুটি, যার মধ্যে একটি সাদা ও একটি কালো পাজেরো গাড়ি। সে সময় দ্রুত গতিতে তাঁরা মো. জাহিদ হাছান (১৮) ও খালাতো ভাই মো. ফয়সাল কে গাড়িতে তোলে চলে যায়। তবে যাওয়ার সময় নিখোঁজের বড় ভাই মো. মেহেদী হাসান বিপ্লব গাড়ির নাম্বারের দিকে নজর দিয়ে পুরোপুরি নম্বর মুখস্ত করতে না পারলেও ৬ ডিজিটের একটি গাড়ির নম্বর জেনে রেখেছিলেন।
পরে জানতে পারেন তুলে নেওয়ার কয়েক ঘন্টা পর অপর খালাতো ভাই ফয়সালকে শহরের আসগরদীঘির পাড় নামিয়ে দিয়ে যায়। হাতে ২০ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁরা জাহিদ কে ফেরত দেয়নি আর।
জাহিদের খালা গুলনাহার বেগম জানান, ‘সে দিন গভীর রাতে তাঁদের বাড়িতে ৫ থেকে ৬ জন লোক ঢুকে পড়ে, যাদের মধ্যে কারো মুখোশ পরা ছিলো না। তাঁরা জাহিদকে ডেকে তুলে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রশাসনের লোক পরিচয় দেয়। তাঁরা কালো মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছিলো।’
এর পরের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্থানীয় পুলিশকে জানিয়ে খবর চাইলেও আজ পর্যন্ত প্রায় ৬ বছরেও কোন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা জাহিদের খোঁজ দিতে পারেনি। পরিবারের লোকেরা এর সন্ধান চেয়ে র্যাবের কাছেও লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
কোন উপায়ন্তর না দেখে নিখোঁজ ছেলের মা হোসনে আরা বেগম চট্টগ্রাম উত্তর পতেঙ্গা র্যাব-৭ এর অধিনায়ক বরাবরেও অভিযোগ দেন তখন। অভিযোগ নম্বর-৭২৪। জিডি সূত্র বলছে, জাহিদের গায়ের রং হালকা পাতলা ফর্সা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। ওই সময় পরিহিত ছিল কালো হাত কাটা গেঞ্জি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফ-এর মহাসচিব বিশিষ্ট কলামিস্ট অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘পরিবারটি এখন আইনি আশ্রয় নিতে পারেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আইনি বিচার চাইতে পারেন। রাষ্ট্রকে অবশ্যই গুম বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পতন হলে একের পর এক ফিরে আসতে থাকেন দীর্ঘ সময় ধরে নিখোঁজ ব্যক্তিরা। তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁরা প্রত্যেকেই বলেছেন, এত দিন তাদের আয়না ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল।