কর্ণফুলীর ‘বাতিঘর খ্যাত’ মাস্টার হাফেজ আহমদ আর নেই

কর্ণফুলী প্রতিনিধি | সোমবার , ১৭ জুন, ২০২৪ at ৯:০৩ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও আওয়ামী লীগ নেতা আয়ুব বিবি ট্রাস্ট ও আজিম হাকিম স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান নির্বাহী মাস্টার হাফেজ আহমদ আর নেই।

আজ (১৭ জুন) সোমবার ভোর ৫ টা ৪০ মিনিটের হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, মাস্টার হাফেজ আহমদ জটিল কোন রোগে আক্রান্ত না হলেও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। আজ বিকেলে আসর নামাজের পর খোয়াজনগর আয়ুব বিবি সিটি কর্পোরেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে তাঁর জানাজা শেষে সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে কিছুক্ষণ মরদেহ রাখা হয়।

একই দিন জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরের পাশে খোয়াজনগর লাল মিয়া কন্ট্রাক্টর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মাস্টার হাফেজ আহমদ এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষজন। তাঁরা জানিয়েছেন, মাস্টার হাফেজ আহমদের মৃত্যুতে কর্ণফুলীবাসী একজন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও সত্যিকার মানুষ গড়ার কারিগরকে হারিয়েছেন।

স্থানীয়দের পাশাপাশি আয়ুব বিবি ট্রাস্ট ও আজিম হাকিম স্কুল অ্যান্ড কলেজের পক্ষ থেকে এই পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে শোকাহত মুহূর্তে কর্ণফুলীবাসী তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁর কর্মযজ্ঞকে সামনে রেখে আগামী দিনেও তাঁকে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করার কথা জানিয়েছেন।

তিনি ১৯৫৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে সম্ভ্রান্ত মুসলিম

পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা লাল মিয়া কন্ট্রাক্টর ও মাতা কুলসুমা বেগম। খোয়াজনগর লাল মিয়া কন্ট্রাক্টর এর ৪র্থ পুত্র। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দুই মেয়ে এবং নিকট আত্মীয়সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

মাস্টার হাফেজ আহমদ ওমরা মিঞা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। দেশ সেবার মহান ব্রত নিয়ে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে ইছানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।

তারপর তিনি ২০০১ থেকে ২০১৪ সালে অবসরের পূর্ব পর্যন্ত চরলক্ষ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরমধ্যে তিনি পশ্চিম জুলধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি আজিম হাকিম স্কুল এন্ড কলেজে প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রবীণ এই শিক্ষক পটিয়া উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

সর্বশেষ আয়ুব বিবি ট্রাস্ট ও আজিম হাকিম স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮৬ সালে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংগঠন দুরন্ত দুর্বার প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। যুবক বয়স থেকে তিনি সমাজ হিতৈষী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে সমমনা যুবকদের নিয়ে জাগরণী সংঘ নামে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেন।

শিক্ষার আলো জ্বালাতে ১৯৯১ সালে খোয়াজনগর গ্রামে আজিম আলীর দানকৃত ভূমিতে কমিউনিটি প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ইছানগর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

নব্বইয়ের দশকে তিনি আজিম পাড়া পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৩ সালে আইয়ুব বিবি উচ্চ বিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ গঠিত হয়। ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে এম এম এরশাদ আহ্বায়ক ও মাস্টার হাফেজ আহমদ সদস্য সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৯৮ সালে মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আইয়ুব বিবি উচ্চ বিদ্যালয় উদ্ধোধন করেই
এটিকে কলেজে রুপান্তরের ঘোষণা দেন।

কলেজ বাস্তবায়ন পরিষদ গঠিত হলে মাস্টার হাফেজ আহমদ কমিটির কো-চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। মসজিদ মাদ্রাসায় তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন। তিনি এরফানুল মুনীর জামে মসজিদের (প্রকাশ লাল মিয়া কন্ট্রাক্টর জামে মসজিদ) ভূমিদাতা।

প্রবীণ এ শিক্ষকের মৃত্যু সংবাদ শোনে কর্ণফুলীর জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘মাষ্টার হাফেজ আহমদ স্যার ছিলেন একজন সমাজ সংগঠক, কর্মবীর ও পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ। যিনি আজ আমাদের মাঝে আর নেই। আল্লাহ যেন স্যার কে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করো (আমিন)।’

আলী আকবর ইমরান বলেন, ‘ঈদুল আজহার মতো আনন্দময় একটি দিনে, এমন একটা শোক সংবাদের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মাত্র কয়েক দিন আগে স্কুলের অফিস রুমে স্যারের সাথে কয়েক ঘন্টা কথা হলো। অথচ আজ সেই মানুষটি আর নেই। এটাই জীবন। তিনি ছিলেন পুরো কর্ণফুলীর বাতিঘর, কর্ণফুলী উপজেলার প্রবাদ প্রতিম পুরুষ, আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কর্মবীর, শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে কর্ণফুলী উপজেলা আজ একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো!’

সাইফুদ্দীন টিপু বলেন, ‘আনন্দের দিনে বড় একটা কষ্ট। না ফেরার দেশে চলে গেলেন সবার প্রিয় মানুষ গড়ার কারিগর মাষ্টার হাফেজ আহমদ স্যার। আমি তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’

আজিম হাকিম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মনজুর আলম বলেন, ‘১১ই জুন স্যারকে নিয়ে আমরা এক সাথে ছবি তুলেছি। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে এখন শুধুই স্মৃতি। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে দুইজন একসাথে ছিলাম। আজ সকালে তিনি দুনিয়ার সফর শেষ করলেন। হৃদয় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঈদুল আজহার নামাজ পড়তে হচ্ছে। দোয়া করি আল্লাহ পাক যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে চামড়া বিক্রিতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা দিলেন ইউএনও