চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ব্যাপক উপস্থিতি নতুন শঙ্কা তৈরি করছে। এটা শুধু পরিবেশ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর অবস্থা দিন দিন ভয়ঙ্কর হচ্ছে। শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় শিল্প, আবাসিক, বাণিজ্যিক সব ধরনের বর্জ্য আর গৃহস্থালির অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য প্রবাহিত হচ্ছে কর্ণফুলীতে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়াবহ উপস্থিতি পরিবেশ ও প্রতিবেশের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে সূত্র বলেছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ হাজার টন বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে যাচ্ছে। এই বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক, পলিথিন, কাচের বোতল, বোতলের ঢাকনা, ফুটপাতের জুতার টুকরা, মাছ ধরার জাল, দড়ি, আবর্জনা, খাদ্যবর্জ্য ও অন্যান্য নন–বায়োডিগ্রেডেবল উপাদান। ভাঙা খাট–পালং, লেপ–তোষক থেকে শুরু করে নানা ধরনের বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে কর্ণফুলী।
গবেষণাগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক পলিউশন ইন দ্য ওয়াটার অ্যান্ড সেডিমেন্ট অব দ্য কর্ণফুলী রিভার’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে প্রায় ১৪.২৩ থেকে ২৬.৬৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। আর পলিতে পাওয়া গেছে প্রতি কেজিতে ৭৫.৬৩ থেকে ২৭২.৪৫টি কণা। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার সাধারণত ০.৩ থেকে ০.৫ মিলিমিটার এবং সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ফাইবার বা থ্রেড আকৃতির কণা। বেশি পাওয়া গেছে পলিথিলিন, পলিফিলাম্যাট্রি, পলিথিন টেরেফথালেট, পলিস্টায়রিন এবং আলকিড রেজিন। নদীর তলদেশের মাটি ও পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব ডাউনস্ট্রিম বা ভাটি এলাকায় অনেক বেশি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ শহরের দিকে যেখানে বর্জ্য ঢুকছে সেখানে সমস্যা বেশি। এর ফলে রাসায়নিক ও ধাতব দূষণ, অঙিজেন ক্ষয়ের মাত্রা, জৈব অঙিজেন, রাসায়নিক অঙিজেন, টঙিক ধাতু যেমন পিবি, ক্রোমিয়াম, নিকেল, সীসার পরিমাণ বাড়ছে। এগুলো পানিতে বসবাসকারী প্রাণীদের জন্য অতি ভয়ঙ্কর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ষা, শীত ও গ্রীষ্মে তিন পর্যায়ে পরিচালিত পরীক্ষায় নদীর নিম্নাঞ্চল সব থেকে বেশি দূষিত পাওয়া গেছে।
গবেষণার ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে, মাছ, শামুক, কাঁকড়া প্রভৃতি জলজ প্রাণী মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো খেয়ে ফেলছে। এসব প্রাণীর মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। ফলে খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে প্লাস্টিক ও সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক ও বিষাক্ত ধাতু অন্তত আংশিকভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা বাড়ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো সাধারণত রাসায়নিক পদার্থ শোষণ করতে সক্ষম হয়। যেমন পেস্টিসাইড, ফাঙ্গিসাইড, প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত অ্যাডিটিভ বা অঙিডিজার ও অন্যান্য হরমোন বদলকারী উপাদান। এর ফলে জলজ জীববৈচিত্র্য ক্ষয় হচ্ছে। মাছের আহারযোগ্য অংশ কমে যাচ্ছে, মাছের প্রজনন হ্রাস পাচ্ছে এবং রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা মানবদেহে অস্বাস্থ্যকর রাসায়নিক জাতীয় প্রদাহ, পুষ্টি অসাম্য, হরমোনজনিত সমস্যা তৈরি করছে।
গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে সূত্র বলেছে, গৃহস্থালির বর্জ্যের পাশাপাশি শিল্পকারখানা থেকে নিষ্কাশিত বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই নদীতে পড়ছে। বৃষ্টির পানি ও ঝড়‐বৃষ্টির সময় রাস্তা, বাজার, আবাসিক এলাকা থেকে নন–বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য খালে এবং খাল হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে।
সূত্রগুলো বলেছে, শহরের রাস্তা, বাজার ও আবাসিক এলাকা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিং না করলে এই সংকটের সুরাহা হবে না। প্লাস্টিক বর্জ্য দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, এই বর্জ্য যাতে অবাধে নদীতে গিয়ে পড়তে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। মাইক্রোপ্লাস্টিক ও প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। বর্জ্য কমিয়ে ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহার বিষয়ে উৎসাহ দিতে হবে। নদী তীরবর্তী কারখানাগুলোকে কারখানার কেমিক্যাল বর্জ্য ও রাসায়নিক নির্গমন নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করতে হবে। এগুলো ঠেকাতে মনিটরিং সেল গঠন করে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবাহ সমুদ্র পর্যন্ত যাচ্ছে। এগুলো ঠেকানোর উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শহরের বর্জ্য যাতে কোনোভাবে নদীতে যেতে না পারে তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এই শহর আমাদের সবার, এই নদী আমাদের সকলের। এই নদীকে রক্ষা করতে সকলকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।












