চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণ কর্ণফুলী নদী বাসাবাড়ি ও শিল্পাঞ্চলের বর্জ্যে প্রতিদিন ভরাট হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মেট্রিক টন গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক, পলিথিন এবং বন্দরের জাহাজ সংক্রান্ত বর্জ্য খাল ও নালা হয়ে কর্ণফুলীতে পড়ছে। বেশ আগের এক প্রতিবেদনে প্রতি মাসে ৬৬ হাজার টন বর্জ্য কর্ণফুলীতে পড়ছে বলে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ আরো বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা একে বলছেন ‘বর্জ্যের স্রোত’।
বিভিন্ন গবেষণা, সরকারি সংস্থার নানা উদ্যোগ, আলোচনা; কোনো কিছুতেই নদীতে আবর্জনা পড়া থামানো যাচ্ছে না। এছাড়া দখল, দূষণ তো আছেই। নদীর প্রস্থ কমেছে, নষ্ট হচ্ছে স্বাভাবিক গতি। জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে। শুধু জলজ প্রাণী কিংবা জীববৈচিত্র্য নয়, চট্টগ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়ছে। কর্ণফুলীতে ‘বর্জ্যের স্রোত’ থামবে কীভাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে হলে নগর, শিল্প ও বন্দর তিন খাতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এক খাতে আনতে হবে। তারা আরো কিছু উদ্যোগের কথা বলেন। আর সিটি মেয়র বলছেন, ময়লা যাতে নদীতে না যায় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
জানা যায়, ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ কর্ণফুলী নদী শুধু চট্টগ্রামের প্রধান নদী নয়, এটি দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত। এ নদীতেই চট্টগ্রাম বন্দর। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এর নাব্যতার উপর নির্ভরশীল বন্দরের সার্বিক উৎপাদন এবং গতিশীলতা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটি দখলে দূষণে বিপর্যস্ত। নদীটি প্রতিনিয়ত ভরাট হচ্ছে, সরু হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের অপতৎপরতার পাশাপাশি নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে নদীর স্বাভাবিক গতি হুমকির মুখে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে ড্রেজিং করলেও নদী ধ্বংস ঠেকানো যাচ্ছে না।
একটি সূত্রে জানা গেছে, নগরীর ৩৬টি খাল ও নালা দিয়ে প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ টন বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। নগরীর ৫২টি খাল ও নালার মুখ রয়েছে কর্ণফুলী নদীর অভিমুখে। এর অনেকগুলো দখল ও দূষণে ভরাট হয়ে গেছে। ৩৬টির মোটামুটি অস্তিত্ব রয়েছে। যেগুলো দিয়ে হরদম বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। এছাড়া নদীর দুই পাড়ের তিন শতাধিক কারখানা নিয়মিত নদী দূষণ করছে। এদের অনেকেই নদী ভরাটের সাথেও জড়িত। নগরীর ৭০ লক্ষ মানুষের বর্জ্য, পলিথিন কর্ণফুলীর তলদেশে বিশাল পলিথিন পাহাড় তৈরি করছে; যা নদী এবং নদীর জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
সূত্র বলেছে, দশ বছর আগে ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতু এলাকা ও চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯শ মিটার। এখন নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪৩০ থেকে ৫১০ মিটারে। নদীর দুই পাড়ে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে দখলদারিত্ব। নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে নানা স্থাপনা, অবকাঠামো। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতি ও প্রবাহ। যাতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের শঙ্কা যেমন জোরালো হচ্ছে তেমনি নদীর কিছু অংশ মরে যাচ্ছে। নদীতীরে চর জেগে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলছে।
নগরীর প্রতিটি খালের মুখ থেকে নদীর গভীর পর্যন্ত ময়লার বিশাল ভাগাড়। যা স্রোতের টানে নদীর আরো গভীর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। ভরাট হচ্ছে নদী, সাগর। যা ক্রমে সাগরের উচ্চতা বাড়িয়ে পুরো নগরীকে হুমকির মুখে ফেলছে। গৃহস্থালি, শিল্প ও বাণিজ্যিক বর্জ্যের মধ্যে কিছু বর্জ্য খালে বা নদীতে পচে গেলেও প্লাস্টিক এবং পলিথিন জাতীয় বর্জ্যগুলো নদীর সর্বনাশ করছে। বিশাল নগরীতে প্রতিদিনই যে নন–বায়োডিগ্রেডেবল (প্লাস্টিক–পলিথিন) বর্জ্য সৃষ্টি হয়, তার একটি বড় অংশ খাল ও নালা হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এর সাথে বন্দরে আসা কয়েক হাজার সমুদ্রগামী এবং লাইটারেজ জাহাজের বর্জ্যও সরাসরি পড়ছে নদীতে। জাহাজ থেকে নদীতে বর্জ্য ফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কেউ মানতে চায় না। ফলে শহরের বর্জ্যের সাথে বন্দরকেন্দ্রিক বর্জ্যের ধকল কর্ণফুলীকে সইতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাড়িঘর, দোকান–বাজার–হোটেল–গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের বর্জ্যের পাশাপাশি কর্ণফুলীকে হুমকির মুখে ফেলেছে প্লাস্টিক, পলিথিন ও প্যাকেট সংস্কৃতি। চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন ২৪৯ টন নন–বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য তৈরি হয়। এর একটি অংশ সিটি কর্পোরেশন সংগ্রহ করে ময়লার ডিপোতে ফেললেও বড় একটি অংশ নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা ও কাগজকলে ত্রুটিপূর্ণ ইটিপি, কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণে না থাকা রাসায়নিক, রং ও তেলজাতীয় বর্জ্য সরাসরি খাল–নালা হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। তরল বর্জ্য নদীর পানির গুণমান ও জলজ প্রাণীর জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, নগর, শিল্প এবং বন্দর এই তিন খাতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এক সুতোয় না গাঁথতে পারলে কেবল কর্ণফুলীতে ‘বর্জ্যের স্রোত’ থামবে। উন্মুক্ত খাল–নালার মুখে ট্র্যাশ–বুম, উৎসে বাছাই করে সংগ্রহের ব্যবস্থা, শিল্প ও বন্দরে জিরো ডিসচার্জ এবং ডেটাভিত্তিক নজরদারি–এই চার চাকা একসঙ্গে ঘুরলেই কেবল প্রতিদিনের হাজার টন বর্জ্যের স্রোত থামানো সম্ভব হবে বলে তারা জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্যকে উৎসে আলাদা করা বাধ্যতামূলক করার কোনো বিকল্প নেই। বাসা, দোকান, হোটেল, ওয়ার্কশপের বর্জ্যকে সংগ্রহ করার আগেই পৃথক ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। সরাসরি বর্জ্য এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য এই দুই ভাগে বাছাই করার ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই কেবল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গতি পাবে। প্রতিটি উৎসে উপরোক্ত ব্যবস্থায় ময়লা ফেলা না হলে জরিমানা এবং যারা নিয়ম মানবে তাদেরকে পুরস্কৃত কিংবা রিবেট প্রদান করা হলে নদীমুখী বর্জ্য বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে। বিশেষ করে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যও যদি নদীমুখী গতি থেকে ফিরিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হিসেবে রিসাইকেল করা যায়, তাহলে সুফল মিলবে। এছাড়া নগরীর যে ৩৬টি খাল দিয়ে নদীতে বর্জ্য যায় সেসব খালের মুখে ‘গ্রিট–ট্র্যাপ বা ট্র্যাশ–বুম’ স্থাপন করলেও সুফল মিলবে। শিল্পে জিরো ডিসচার্জ ও রিয়েল টাইম মনিটরিং, ইটিপি মনিটরিং, রাতের বেলা ডিসচার্জ বন্ধে অনলাইন সেন্সরিংসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব আসবে। বন্দরে আসা জাহাজগুলোর ব্যাপারেও কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সিরিয়াস। আমরা নানা উদ্যোগে বাসা–বাড়িসহ প্রতিটি স্থাপনা থেকে ডোর টু ডোর ময়লা সংগ্রহের কার্যক্রম আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছি। আমরা ইউকে, জাপান এবং কোরিয়ার সাথে এই ব্যাপারে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। কোরিয়া দ্রুত কাজ শুরু করতে চায়। তারা ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করেছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিদিন তিন হাজার টন ময়লা হয়। এই ময়লার কিছু অংশ খাল ও নালা হয়ে নদীতে পড়ে। কিন্তু এখন থেকে কোনো ময়লা যাতে আর খাল কিংবা নালায় না যায় সেজন্য আমরা ডোর টু ডোর ময়লা সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করেছি। এখন থেকে কোনো ময়লা আর যাতে কেউ খাল বা নালায় না ফেলেন সেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
মেয়র বলেন, আগে আমরা সবুজ, হলুদ ও লাল তিনটি বিনে তিন ধরনের ময়লা সংগ্রহ করে ওয়েস্ট টু এনার্জি এবং ওয়েস্ট টু ফার্টিলাইজার প্রজেক্ট করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বলা হয়েছে, ডোর টু ডোর সংগ্রহ করে সব বর্জ্য একসাথেই আমাদের গারভেজ স্টেশনে যাবে। ওখানে শর্টিং করে বর্জ্য থেকে সার এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া যেটা পুনর্র্ব্যবহারযোগ্য সেটিকে পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, নগরীর ময়লা যাতে আর কোনোভাবেই নদীতে গিয়ে না পড়ে সেই ব্যবস্থা আমরা করছি। এক্ষেত্রে তিনি নগরবাসীর সহায়তা কামনা করেন।