বন্দর ও বঙ্গোপসাগর মোহনাকে কেন্দ্র করে জ্বালানি তেলের চোরাচালান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা থাকলেও নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভোজ্যতেলের চোরাচালান। তিনদিন আগে কর্ণফুলী নদী থেকে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের (পাম অয়েল) চোরাচালান আটক নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশ হাতেনাতে ৫জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। ইতোমধ্যে চক্রের হোতাদের চিহ্নিতও করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলতে পারে বলে আশা পুলিশের।
নৌ পুলিশ বলছে, বহির্নোঙরের মাদারভ্যাসেল থেকেই এসব চোরাই তেল চোরাকারবারীদের হাতে আসে। আর অপরিশোধিত এসব ভোজ্যতেল পরিশোধন ছাড়াই খুচরা বাজারের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভোক্তাদের হাতে। এতে আমদানিখাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি অপরিশোধিত ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিএসটিআই চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘অপরিশোধিত ভোজ্যতেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিএসটিআইয়ের নিয়ম মোতাবেক এ ধরনের তেল ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ অবৈধ। তবে খেলে কেমন ক্ষতি হয়, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।’
চট্টগ্রামের জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘অপরিশোধিত ভোজ্যতেল অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। পরিশোধন করেই ব্যবহার করা উচিত। কারণ অপরিশোধিত তেলে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলো মানবশরীরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী, পাকস্থলীর সমস্যা তৈরি করতে পারে, কিডনির ক্ষতি করতে পারে, লিভারের সমস্যা হতে পারে। যদি কোনোভাবে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল বাজারজাত হয়ে থাকে, তাহলে এসবের বাজারজাত বন্ধে প্রশাসনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
নৌ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ ডিসেম্বর দিবাগত গভীর রাতে গোপন খবরের ভিত্তিতে কর্ণফুলী নদীতে অভিযান পরিচালনা করে সদরঘাট নৌ-পুলিশের একটি টিম। অভিযানে কর্ণফুলী থানাধীন দক্ষিণ শাহমীরপুর বাবুর পুকুর পাড় সংলগ্ন কর্ণফুলী নদী থেকে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্যের ৬ ফুট প্রস্থের ২০-২২ হর্সপাওয়ার স্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকার মধ্যে খোলা অবস্থায় আড়াই হাজার লিটার অপরিশোধিত পাম অয়েল জব্দ করা হয়। এসময় নৌকা থেকে পাঁচজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, কর্ণফুলী থানাধীন জুলধা গ্রামের মৃত মনু মিয়ার ছেলে মো. সেলিম (৩৪)। বদলপুরা গ্রামের মৃত মীর হোসেনের ছেলে মো. সাদেক (৩৫), জুলধা গ্রামের মৃত কোরবান আলীর ছেলে মো. আবদুর রহিম (৩৫), একই গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে মো. ইব্রাহীম (৩৭) ও মো. জামালের ছেলে মো. লোকমান (৪০)। তাদের বিরুদ্ধে ৮ ডিসেম্বর কর্ণফুলী থানায় মামলা দায়ের করে নৌ-পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন।
এ ব্যাপারে সদরঘাট নৌ থানার ওসি এবিএম মিজানুর রহমান শুক্রবার বিকেলে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা গত মঙ্গলবার কর্ণফুলী নদী থেকে অপরিশোধিত পাম অয়েল ভর্তি একটি নৌকা জব্দ করেছি। ওই নৌকা থেকে ৫জনকে গ্রেপ্তারও করেছি। আমরা আগে বিভিন্ন সময়ে চোরাই জ্বালানি তেল এবং নানান চোরাই পণ্যসহ অনেককে গ্রেপ্তার করেছি। কিন্তু গত প্রায় দুই বছর আমার দায়িত্বকালে ভোজ্যতেল আটকের এটি প্রথম ঘটনা। ৫জনের মধ্যে দুইজন লেবার রয়েছে। আমরা আদালতে গুরুত্বপূর্ণ তিনজনকে রিমান্ডে নিতে আবেদন জানিয়েছি। তন্মধ্যে সেলিম সম্ভবত চোরাই সিন্ডিকেটের প্রধান খ্যাত তেল শুক্কুরের ম্যানেজার। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে কারা জড়িত, সিন্ডিকেটে কারা কারা আছে, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি এসব তেল মূলত বহির্নোঙরের একটি মাদারভ্যাসেল থেকে এসেছে। মাদারভ্যাসেলের সাথে চোরাইচক্রের সাথে সংযোগ তৈরির জন্য আরেকটি পক্ষ রয়েছে। যারা কমিশনের ভিত্তিতে চোরাই ব্যবসায়ীদের সাথে মাদারভ্যাসেলের লোকজনের সংযোগ তৈরি করে দেয়। এতে বুঝা যাচ্ছে এসব ভোজ্য তেল চোরাইপথে বাজারে যাওয়ার সাথে মাদারভ্যাসেলগুলোর লোকজনও জড়িত। এতে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে ভোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ এসব চুরি যাওয়া তেল সিস্টেম লস দেখানোর কারণে বাজারে তেলের মূল্যে প্রভাব ফেলে। প্রকারান্তরে এসব টাকা ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করেন ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে আতংকের বিষয় চোরাই চক্রের কাছে তেল শোধনাগার নেই। তারা পরিশোধিত ভোজ্যতেলের সাথে মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে এসব অপরিশোধিত ক্রুড। এতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করে।’