করোনা হলেই আতংক নয়

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যা করতে বললেন

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

করোনা শনাক্ত হলেই আতংক নয়। প্রয়োজন মনোবল শক্ত রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। পজিটিভ হলে হাসপাতালে ছুটে যেতে হবে না। কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া যাবে না। কারণ, বাসায় থেকেও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ গ্রহণে সুস্থ হচ্ছেন করোনা রোগীরা। তাই বলে সংক্রমিত হলে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। বেশি খারাপ লাগলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হব, দূর করতে হবে এমন ভাবনাও। অনেক ক্ষেত্রে অবহেলায় ডেকে আনে ভয়াবহ বিপদ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপকালে এমনটিই জানিয়েছেন তারা। চিকিৎসকরা বলছেন, সামান্য উপসর্গ দেখা দিলেই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। আইসোলেশনে যেতে হবে। অনুসরণ করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। উপসর্গ দেখা দেওয়ার চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে করতে হবে পরীক্ষা। পজিটিভ এলেই পরামর্শ নিতে হবে চিকিৎসকের। সংক্রমিত হওয়ার পর জ্বর, কাশি বা সর্দি থাকলেই হাসপাতালে ভর্তির জন্য দৌড়াতে হবে না। এক্ষেত্রে জাতীয় হটলাইন, সিভিল সার্জন অফিস, সিটি কর্পোরেশন বা অন্য চিকিৎসকের টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মানতে হবে। কোনোভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া পরামর্শ মেনে ওষুধ খাওয়া যাবে না। আবার শ্বাসকষ্ট বা অঙিজেন অঙিমিটারে যদি ৯৩ শতাংশের নিচে চলে আসে, বুকে ব্যথা ও তীব্র কাশি থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় আজাদীকে বলেন, খুব বেশি আতংকিত হওয়া যাবে না। আবার একেবারে অবহেলাও করা যাবে না। বেশি খারাপ লাগলেই হাসপাতালে যাব এমন মানসিকতা থাকলে হবে না। তিনি বলেন, গাইডলাইন সবার জন্য একরকম হবে না। যার কোভিড পজিটিভ আসছে তার নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা লাগবে তা নির্ভর করে ওনার বয়স, অন্যান্য অসুখ কী আছে বা অন্য অসুখের জন্য কী ধরনের ওষুধ খাচ্ছেন তার ওপর ভিত্তি করে। তাই সব কোভিড রোগীর জন্য উপদেশও একই হবে না।
তিনি বলেন, যদি পজিটিভ আসে এবং সিনড্রম থাকে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন। আবার এ কথা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে না। যেমন কারো বয়স যদি ৩০ বছর হয় এবং ওনার কোভিড পজিটিভ হয় ও তার সর্দি-কাশি জ্বর থাকে তাহলে বলব বাসায় থাকেন। জ্বর ১০০ পার হলে প্যারাসিটামল ও ভিটামিন খান। অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো রুল এখানে নেই। কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। আবার যার বয়স ৭০ তার জন্য এটা প্রযোজ্য না। ওনাকে বলব, ডাক্তারের কাছে যান। কারণ ওনাকে ফিজিক্যিালি দেখা দরকার। ওনার হার্টের কোনো সমস্যা আছে কিনা, ফুসফুসে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, ডায়াবেটিস থাকলে কন্ট্রোল আছে কিনা, আগে থেকে কোন ওষুধগুলো খাচ্ছেন তা দেখতে হবে।
ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, সবাইকে যদি বলি ঘরে বসে থাকেন, কিছুই হবে না, তাহলে সেটা হবে অনেক ভুল তথ্য। আবার সবাইকে যদি বলি, হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হন সেটাও উচিত হবে না। আতংকিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে হাসপাতালে যাওয়ারও দরকার নেই। বাসায় যদি অঙিজেন মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকে সেক্ষেত্রে কিন্তু আবার অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। অঙিজেন সার্কুলেশন যদি কমে যায় সেক্ষেত্রে হাসপাতালে যেতে হবে।
এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, ফেসবুক দেখে ওষুধ খাওয়া যাবে না। যিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি জানেন না, আসলে কী সমস্যা হয়েছে। ফেসবুকে পাওয়া ‘এটা খান, ওটা খান’ জাতীয় উপদেশগুলো গ্রহণ করা যাবে না। চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে হবে।
উপসর্গ দেখা দেওয়ার ক’দিনের মধ্যে পরীক্ষা করা উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপসর্গ দেখা দেওয়ার প্রথম তিন দিন তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। তৃতীয় দিনের পর থেকে পজিটিভ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেজন্য তিন দিন অপেক্ষা করে চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে পরীক্ষা করা উচিত। আবার একেবারে ১০ দিন বসে থাকলেও হবে না। এতে জটিলতা বাড়তে পারে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ও করোনা ইউনিটের চিকিৎসক ডা. এ এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী আজাদীকে বলেন, এখন কোভিড অনেক বাড়ছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক রোগী বেড়েছে। যেভাবে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তেমনভাবে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। চট্টগ্রামেও একই অবস্থা। অনেকে বলছে নিউ ভেরিয়েন্ট; যা অনেক বেশি সংক্রামক এবং সেটার জন্য হচ্ছে। যদিও বিষয়টা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
তিনি বলেন, রোগীর সংখ্যা অনেক বাড়ছে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে যানবাহনে যাত্রী সংখ্যা কমানো, স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ যেসব নির্দেশনা আছে সেগুলো মানতে হবে। মানুষের জন্য সেই পুরনো আহ্বান থাকবে, মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, অহেতুক বাইরে ঘোরাফেরা করা উচিত হবে না।
ডা. মেহেদী বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আমরা এড়িয়ে চলি বা খেয়াল করা হয় না। কারো যদি জ্বর-কাশি আসে তাহলে তাকে শুরুতেই পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। সাধারণত মানুষ সেটা খেয়াল করে না। তারা সাধারণ সর্দি, কাশি জ্বর হয়েছে ধরে নেয় এবং মনে করে করোনা হয়নি। কিন্তু সেটা উচিত না। কারণ, টেস্ট না করা পর্যন্ত তো করোনা হয়নি বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্যই আইসোলেশনে চলে যাওয়া উচিত। বাইরে ঘোরাফেরা করা যাবে না। সাথে ন্যাশনাল হটলাইন বা টেলিমিডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, অনেকে আতংকগ্রস্ত হয়ে পজিটিভ হওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য দৌড়ায়। হালকা জ্বর-কাশি হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ না কিন্তু। এতে আতংকিত হওয়ারও কিছু নেই। যদি কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন শ্বাসকষ্ট বা অঙিমিটারে যদি ৯৩ শতাংশের নিচে চলে আসে, বুকে ব্যথা, তীব্র কাশি থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর বাইরে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার জন্য টেলিমিডিসিনগুলো চালু আছে। যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিভিল সার্জনের অফিসের মাধ্যমেও টেলিমিডিসিন সেবা নেওয়া যায়। অনেক চিকিৎসকও টেলিমিডিসিন সেবা দেন। সরাসরিও দিচ্ছেন। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ।
উপসর্গ দেখা দেওয়ার কতদিনের মধ্যে কোভিড টেস্ট করা উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, লক্ষণ শুরু হওয়ার পরই টেস্ট করা যায়। অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করবে। আবার একদিন বা দুদিনের মধ্যে করতেই হবে এমন কিছু না। সন্দেহ হলে অথবা চিকিৎসক পরামর্শ দিলে করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় নতুন কোনো উপসর্গ যোগ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন তেমন কিছু নেই। পুরনোগুলোই। মোটামুটি জ্বর, কাশি, সর্দি হচ্ছে। তবে এবার বলা হচ্ছে, খুব দ্রুত অনেকে খারাপ হচ্ছে। দ্রুত শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে এবং খারাপ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা চিকিৎসায় ছড়িয়ে পড়া ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এটা খুব বিপজ্জনক হতে পারে। একজন এক ধরনের চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন বলেই একই চিকিৎসা অন্যজনের জন্যও কার্যকর হবে তা কিন্তু না। সবার জন্য একই চিকিৎসা হয় না। যেহেতু করোনা ভাইরাসজনিত রোগ তাই অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই ভালো হয়ে যাবে, সেটাও না। জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নে যে পরামর্শ এর বাইরে আর কিছু করা উচিত হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশতভাগ প্রস্তুত চট্টগ্রাম
পরবর্তী নিবন্ধলকডাউনের খবরে বাজারে ভিড়