সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নজিরবিহীন অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, চিকিৎসাশাস্ত্রেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে একটার পর একটা সাফল্য বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও কম অগ্রগতি হয় নি। অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট মানুষের অদক্ষতা, অবহেলা, লোভ, প্রতারণা, অমানবিক ও অনৈতিক কিছু ঘটনা সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি গণমানুষের ভয়ঙ্কর আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে। এছাড়া প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট নিয়ে নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়, তা রোগ নির্ণয়ে সংশ্লিষ্টদের অবহেলা-অদক্ষতা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মারাত্মক আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
গত ২৩ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে ‘করোনার রিপোর্টে বিভ্রান্তি, এক ল্যাবে পজিটিভ তো অন্যটিতে নেগেটিভ’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে তেমন আস্থাহীনতার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘কোভিড-১৯ তথা করোনা টেস্টে বিভ্রান্তি বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। টেস্ট রিপোর্টের বিভ্রান্তি বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট আস্থাহীনতাও তৈরি করছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সবাই।’ সংবাদে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে তাঁরা বলেছেন, কোভিড পরীক্ষা একটি নতুন বিষয়। পিসিআর টেস্টে ফলস রিপোর্ট হতে পারে। এটি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হওয়ার আশংকা থাকে। এই ফলস রিপোর্টই করোনার বিস্তার ঘটাচ্ছে। রিপোর্টের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার উপর জোর দিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই রিপোর্টের উপরই একজন রোগীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে সবকিছু নির্ভর করে। এটি মিথ্যা হলে যে কোনো মানুষ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পজেটিভ থেকেও যখন করোনা টেস্টে নেগেটিভ আসে, তখন এ ধরনের ভুল ফলাফলকে ‘ফলস নেগেটিভ’ রূপে অভিহিত করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ যাবৎ বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ১৫-৩০ শতাংশ ‘ফলস নেগেটিভ’ রিপোর্ট দিতে পারে। সুতরাং পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হলেই করোনা সংক্রমণ হয়নি এমনটি নিশ্চিত রূপে ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু করোনা শনাক্তকরণে এ ধরনের ‘ফলস নেগেটিভ’ মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। একদিকে এর ফলে সংক্রমিত ব্যক্তি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, অপরদিকে তিনি নিজেকে সংক্রমণমুক্ত জেনে অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশে তাদেরও সংক্রমিত করতে পারেন। এখন এ ধরনের ‘ফলস নেগেটিভ’ আসাটা যদি একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন বলেছেন, এমনটি কেবল যে আমাদের দেশেই হচ্ছে তা নয়। সারা বিশ্বেই চিকিৎসকদের জন্য করোনা পরীক্ষার ফলাফলে এ ধরনের বিভ্রাট একটি জটিল সমস্যা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। স্বয়ং চীনা ডা. লি ওয়েনলিয়াং, যিনি সর্বপ্রথম বিশ্বকে এ রোগটির বিষয়ে জানান দেন এবং নিজেও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি শনাক্ত হওয়ার পূর্বে বেশ কয়েকবার তার করোনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে। জাপানিজ জার্নাল অব রেডিওলোজির ২০২০ সালের মে মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, ৩৪ বছর বয়সি এক ব্যক্তি আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ প্রমাণিত হওয়ার আগে পর পর চার বার তার ফলাফল নেগেটিভ আসে। আসলে যে কোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রেই ফলাফলে অল্প-বিস্তর বিভ্রাট ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের কনজেনিয়াল হেলথ নামক সংস্থার প্রধান ডা. অ্যালাইন চাউই দ্য বোস্টন গ্লোবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার অনেক রোগী, যাদের লক্ষণাদি দেখে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত বলে মনে হয়, পরীক্ষায় তাদের নেগেটিভ আসছে।’ এ কারণে তার যেসব রোগী পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন, তিনি তাদের সবাইকে, পরীক্ষার ফল যাই হোক, নিজেদের পজিটিভ বিবেচনা করার এবং অন্তত ৭২ ঘণ্টা উপসর্গমুক্ত না থাকলে কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
তবু করোনা পরীক্ষায় আমরা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের কোনো প্রকার অবহেলা বা অমনোযোগিতা প্রত্যাশা করি না, আমরা তাঁদের নিবিড়, সুষ্ঠু ও নিঃশঙ্ক মনোযোগ চাই, যেন তাঁদের পর্যবেক্ষণ শক্তি তীক্ষ্ণ ও প্রখর থাকে। তাঁদের আরো বেশি দায়িত্বশীল এবং যত্নশীল হওয়া দরকার বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন।