হাট-বাজারে নেই আধাযুগ। বই, সিগ্রেটসহ ব্যাক্তিগত খরচ নিজে যোগাই, বাকিসব ফ্রি। পেশাগত দরকারে কিছু পণ্যের খোঁজ রাখি। রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে সিগারেটসহ কিছু কিনিও।
মৃত্যুর মিছিল ও লকডাউনে যাওয়া হয় না। গেলাম, কিছু দায়ও ছিল। কাজ সেরে গাড়িতে উঠতেই নাম ধরে তীব্র ডাক। চমকে পেছন ফিরতেই বন্ধুর মুখোমুখি। ওকে বাজারে দেখে বিস্ময়ে চোখ আলুবোখারা! ভাবনার ট্রেনে কড়া ব্রেক চেপে বন্ধুর প্রশ্ন, কি কিনছিস?
এই টুকটাক…
চল, বলেই হাত ধরতে গিয়ে আটকে যায় করোনা সতর্কতায়। পাহলোয়ান মানে বিশাল কর্পোরেট নির্বাহী বন্ধুটি গার্ডদের রেখে আমাকে নিয়ে একটা মাঝারি গ্রোসারি দোকানে ঢুকে। সব পণ্যের নমুনা ছোট ছোট কৌটায় সাজিয়ে রাখা। বাকিটা ফাঁকাই প্রায়। এগুলো নমুনা, পণ্য থাকে গুদামে। দেখে মালিক ভদ্রলোক এক লাফে গদি ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। ভদ্রলোক বেশ সৌখিনও। ‘স্যার স্যার’ বলতে বলতে লালা শুকিয়ে রোযায় আলটাকরা খসখসে করে ফেলেন। একগোছা টিস্যু টেনে নিয়ে দু’তালু কচলে কাছের সহকারিকে ইশারা দেন। লোকটি হাতে তুলে দেন ইয়া লম্বা এক চোতা। খুব যত্নে গুটিয়ে নিয়ে বন্ধুর হাতে দিতে যান তিনি। এতো বিনয়, যেন কোটি টাকার হিরের বাকশো! চোতা গ্রোসারি দোকানে চলে, জানি। এটা এত বেশি লম্বা, টেনে নিলে এক কিলোমিটার পেতে দেয়া যাবে! বন্ধু ছুঁয়েও দেখে না।
চোখ গোল করে কড়া মেজাজে বলে, অমুক মিয়া রাখেন, মালের সাথে পাঠিয়ে দিবেন। মাল কী লোড হয়ে গেছে?
জ্বি স্যার
ঠিকাছে। আরো মাল লাগবে।
তোর বাসার ঠিকানা দে’তো! বন্ধু চট করে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে।
কেন, চিনিসইতো!
চুপ থাক। অন্তত ক’মাসের খাবার ও নিত্যপণ্য বাসায় থাকবে। যা অবস্থা, পরে বড় সঙ্কট হতে পারে।
তোর মাথা ঠিক আছে, কী সব বলছিস?
‘জ্বি, স্যার হাঁচাই। সব ‘বড়লোক’ তাই করছেন। দু’মাস থেকে ছ’মাসের খাবার কিনে রাখছেন। দামও বাড়ছে। এখন কিনে রাখলে পস্তাতে হবেনা’, গাবদাগোবদার যুক্তি।
দোকানিকে এড়িয়ে বন্ধুকে বলি, দোস্ত মাফ দে, আমার দরকার নেই। বাজার ছেলে-বউমার জিম্মায়, ওরাই বুঝবে।
‘রাখ তোর বুঝাবুঝি।’ বন্ধুর হুঙ্কার।
তোর পায়ে পড়ি ভাই। আমি পারবো না।
হম্বিতম্বির পরও ‘হ্যাঁ’ আদায়ে ব্যার্থ বন্ধু তেঁতে লাল, ‘ঠিক আছে, মর তুই।’
জানাযায় আসবি কিন্তু, দূরত্ব রেখে দাঁড়াবি,
ঠাট্টা করে বিদায় নিই।
বন্ধুটির নগরে আলিশান অফিস। গ্রুপ অব কোম্পানিজের এমডি। আন্তর্জাতিক চেইনসহ বন্দরের সাথে বিশাল ব্যবসা। সর্দিকাশিতেও সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড উড়ে। প্রতি রমজানে পুরো পরিবারসহ ওমরাহতো আছেই। এখন লকডাউন ফাঁদে।
ওর কব্জা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিচিত দোকানে গিয়ে সত্য টেনে আনি। হ্যাঁ, কিছু ধনী বাড়তি বাজার করছে। লক ডাউনের পর থেকে। তাদের যুক্তি, ‘টাকাতো অনেক রোজগার করেছি, করবোও। ক’মাস বসে খেলে কী ক্ষতি! খাবোই যখন, আরামে খাই!’ আজব যুক্তি! তাদের কারণে বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে। সাথে অতিলোভী, চিনেজোঁক মাফিয়া ব্যবসায়িতো আছেই। উল্টোচিত্রও আছে। যারা এই দলে নেই। স্বাভাবিক বাজারই আসছে ঘরে। এদিকে করোনা ছোবলে অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানি। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, ব্যাবসা বন্ধ, বিশাল বিশাল তালা আরামে ঘুমাচ্ছে অফিস-দোকানে। সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তের অবস্থা করুণ। আগে স্বচ্ছলতা না থাকলেও সংসারে অভাব ছিল না। ভয়াল ও দীর্ঘ করোনা আতঙ্কের সাথে মিলেছে অভাবও। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, মধ্যবিত্তসুলভ আব্রুতে ভয়ঙ্কর টান পড়েছে। এরা চাইতেও জানে না, বলতেও না। সরকারি ও বেসরকারি বেশিরভাগ সহায়তা নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্রের ঘরে। কোন কোন সহায়তাকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারসহ কিছু ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান গোপন উপহারের প্যাকেট পাঠাচ্ছে মধ্যবিত্তের ঘরে। কারো কারো ধনী আত্মীয়স্বজনও হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু প্রয়োজনের সমুদ্রে এসব কিছুই না। অনিশ্চিয়তার ভয়াবহতায় হাবুডুবু খাচ্ছেন তাঁরা। করোনার থাবা যত ভয়ঙ্কর হচ্ছে, ততই অভাবের বিশাল খাদ বিশেষ শ্রেণিকে মানসিক ট্রমায় ঠেলে দিচ্ছে। যা সামনে আরও বড় জাতীয় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ভোগী ও আয়েশি ধনীরা যদি অতিরিক্ত নিত্যপণ্য কেনার প্রতিযোগিতা দেন, এরচেয়ে বড় অমানবিকতা আর কী হতে পারে? কাজির দেউড়ি ‘অভিজাত কাঁচা বাজারে’ এক ডজন কলা ২০০/২৫০ আর ছোট তরমুজ ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে! সাধারণ ভোক্তাদের হবেটা কী! আশা করি সংশ্লিষ্টরা একটু মানবিক হবেন। সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোকেও সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে। আসলে ধনীসহ সরকারি আমলা, কর্মচারি,ব্যাঙ্ক ও কিছু বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থার কর্মী ছাড়া দেশের প্রায় সব মানুষ লম্বা অনিশ্চয়তার ভয়াবহ আবর্তে।
৮০% মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে। নিত্যপণ্যের দাম পতন স্বাভাবিক ছিল। ঘটছে উল্টো। করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা এবং মজুদদারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সর্বোচ্চ মনোযোগ জরুরি হয়ে পড়েছে। করোনা উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন থেকেই আগাম প্রস্তুত নেয়াও দরকার।