বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ পার হতে চলছে, ইতিমধ্যে নানান শিল্প উদ্যোগে এবং আধৃনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এর অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি এবং ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমান। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুজ একটি দেশ। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশের কর্মক্ষম জনগণকে কর্মকুশল দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার অনিবার্যতা মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত । কেননা ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসমষ্টির আওতায় চলে এসেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নামে পরিচিত। সনাতন শর্তানুযায়ী ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট মূলত ৩ দশক পর্যন্ত সৃজনশীল এবং উন্নয়ন অভিসারী অভিযাত্রায় থাকে। ইতিমধ্যে তার এক দশকের বেশি সময় চলে গেছে, সামনে আরো দেড় দুই দশক বাকী আছে। ইতিমধ্যে গত প্রায় দুবছরে মহামারি করোনা বিশ্বের অন্যন্য দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতি , জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে হলাহলপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। করোনা উত্তর পরিবেশ পরিস্থিতিতে বিদ্যমান কর্মপোযোগীদের কে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে বা তাদেরকে উপযুক্ত কর্মসম্পাদনে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ এবং পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তারা অলসতায় শয়তানের কর্মশালায় যোগ দিতে পারে কিংবা অকর্মন্যতায় আরো হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে, যে পরিস্থিতিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ডিজাষ্টারে পরিণত হতে পারে। কেননা সমাজে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতায় বা জিডিপিতে তাদের অবদান বঞ্চিত হয় দেশ এবং তারা নিজেরাই নিজেদের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা বা বিপদের বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে জাতির জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর সময় এবং এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে বিশেষ মাশুল।
বিগত পাচ দশকে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশের জনগণকে বিশেষ করে যুব সমাজকে এখনো পর্যাপ্ত যথাযথ দক্ষ জনসম্পদে বা প্রশিক্ষিত লোকবল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। যার জন্য এদেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক আর বিদেশের দক্ষ জনবল এদেশের মধ্য ও উচ্চতর পদগুলিতে বেশি বেতনে নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনকারী ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু তাদেরকে দেশের উদীয়মান শিল্পে, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়োগযোগ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছেনা। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সেই বিখ্যাত চরণের মত ডধঃবৎ ধিঃবৎ বাবৎুযিবৎব হড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা ও বাণিজ্য অনুষদের এক গবেষণায় বাংলাদেশী কমী ও ব্যবস্থাপক পর্যায়ের জনসম্পদের মধ্যে চিহ্নিত সীমাবদ্ধতা সমূহের মধ্যে ’উৎপাদন কিংবা সেবা খাতে করিৎকর্মা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করা বা উপস্থাপন বা তুলে ধরার মত প্রযোজ্য প্রয়োগিক ভাষা ও জ্ঞানের অভাব। তাদের মধ্যে সৃজনশীল তথা উদ্ভাবনী শক্তি প্রকাশে, প্রয়োগে সংশয়, সংকোচ তথা অপরাগতা বিদ্যমান। বাজারজাতকরণে নৈপুণ্য প্রদর্শন,দক্ষতা, আগ্রহ ও তৎপরতায় ঘাটতি। ক্রয় বিক্রয় পরিচালনায়, পরিবেশনে, উপস্থাপনে, নেগোশিয়েশনে নিষ্ঠার অভাব।
বিভিন্ন পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশের জন্য উঠতি বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কিংবা অধিকতর যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মত উপর্যুক্ত ও দক্ষ জনবলের যেমন প্রয়োজন তেমনি টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ ও সমন্বয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তার সাথে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম কুশলতা। এই প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, সেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে তা মোকাবেলা করার জন্য পর্যাপ্ত ও উপর্যুক্ত লোকবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
এই সহস্রাব্দের শুরু থেকে বলতে গেলে বিশেষ করে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন যখন শুরু হয় তখন থেকে বাংলাদেশে দক্ষ জনবল বা মানবসম্পদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। দাতা সংস্থার পরামর্শ ও অর্থায়নে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংস্থা, প্রকল্প, সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ গৃহীত হলেও দৃশ্যমান দক্ষ জনবল সেভাবে যে গড়ে উঠেনি তা বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে কর্মসৃজন, বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর এবং এদেশে বিদেশীদের নিয়োজ্জন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে প্রতিভাত হচ্ছে। বিগত দেড় দশকে বরং দেখা গেছে প্রতিবেশী দেশ সমূহ থেকে উর্ধ্ব ও মধ্যম পর্যায় ব্যবস্থাপক, পরামর্শক, সংগঠন ও কর্মীরা এসে বাংলাদেশে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন আর্থিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হয়েছে, ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে প্রত্যাবাসিত হচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে দক্ষের পরিবর্তে অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের মাত্রা বেড়েছে। যদিও এই দেড় দশকে দেশে পরীক্ষায় পাস নির্ভর প্রচুর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে বা শ্রম বাজারে প্রবেশ করেছে কিন্তু উঠতি বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মত পর্যাপ্ত ও কার্যকর জ্ঞান দিয়ে তাদের নিয়োগ করা যায়নি এই অনুযোগে যে, তারা প্রতিবেশী দেশ সমূহের কর্মীদের তুলনায় চটপটে, পটু, প্রায়োগিক জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া থেকে পিছনে রয়েছে। এইরূপ অদক্ষ অর্ধ শিক্ষিত জনসম্পদ বছর বছর তাদের চাকুরীর বয়স খুইয়ে স্থায়ী বেকারে পরিণত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও বিণিয়োগের যে কর্ম সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে উপযুক্ত দেশীয় লোকবল সংস্থান করা যাচ্ছেনা; অথচ সেগুলো বিদেশীদের দ্বারা পূরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্প একটি অতি সম্ভাবনাময় শ্রমিক নির্ভর শিল্প। সেখানে মধ্য পর্যায়ের অধিকাংশ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নকশাকার হিসেবে নিয়োজিতরা বিদেশী। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, গার্মেন্টস এর বায়াররা প্রতিবেশী দেশে (যারা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী) বসে সে দেশের লোক নিয়োগ না করলে আমাদের বাজার হারাতে হবে- এ ধরনের একটি অঘোষিত হুমকি রয়েছে। এর ফলে দেশী শিক্ষিত বেকারকে কর্মসংস্থানের চাহিদাকরণে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকুরী না পেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। সাম্প্রতিককালে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সেই হতাশার বেদনা বাঙম্য় হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। একই সময়ে দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের পরিস্থিতি এমন একটি নৈতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে যে দীর্ঘ মেয়াদে তাতে এক করুণ ও আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আশংকা প্রকাশ পাচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ডেমোগ্রাফিক ডিজস্টারে পরিণত হতে পারে।
জন সম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ শুধু জরুরী নয়, অনিবার্যও বটে। এখনই যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয় তাহলেও আমাগী ১৫ বছরের আগে সেই দক্ষ জনবলের সাক্ষাৎ মিলবেনা। ততদিনে বর্তমানে বিদ্যমান বেকার ও অদক্ষ শিক্ষিত জনসম্পদ উপরে ও নীচের জন্য জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকবে। ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান পর্যায়ে বিদেশীদের নিয়োগ অব্যাবহত থাকলে বা রাখলে দেশের চাকুরী বাজার দেশীয়দের জন্য আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এহেন পরিস্থিতি থেকে কার্যকরভাবে পরিত্রাণ পেতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান।