করোনা আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে চার বছরের এক শিশু। তাকে চিকিৎসা দিতে আইসিইউর সংকট চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ওই শিশুর করোনা পজিটিভ হওয়ার সাথে সাথে পুরো হাসপাতালে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। নগরীর চিকিৎসা সেক্টরেও ছড়িয়েছে তা। এত ছোট শিশুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউ ভেন্টিলেশন পর্যন্ত যাওয়ার নজির চট্টগ্রামে নেই। চট্টগ্রামের কোথাও করোনা আক্রান্ত শিশুদের জন্য আইসিইউ ভেন্টিলেশন সুবিধা নেই। গতকালের ঘটনার পর চট্টগ্রামের কোভিড আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা একটি আইসিইউ ভেন্টিলেশন সুবিধা সম্বলিত ব্লক তৈরির বিষয় সামনে এসেছে।
চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চার দিন আগে হালকা জ্বরে আক্রান্ত হয় মাহির হোসেন নামের সাড়ে চার বছরের একটি শিশু। তাদের বাড়ি কক্সবাজার। থাকে নগরীর চান্দগঁাঁও থানাধীন বহদ্দারহাটের খতিবের হাট এলাকায় আমেনা ভবনে। মাহিরের পিতা মোহাম্মদ আজাদ দুবাই প্রবাসী। মা আফরোজা বেগম গৃহবধূ। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান মাহিরের জ্বর নিয়ে তেমন শঙ্কা ছিল না কারো। আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে জ্বর হতে পারে বলে ধারণা করেন তার মা আফরোজাসহ পরিবারের লোকজন। দ্বিতীয় দিন জ্বর ছিল না। তৃতীয় দিন রাতে আবার জ্বর আসে। ভোরে তীব্র শ্বাসকষ্ট। মাহিরকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় বাসার নিকটস্থ শমসের পাড়ার ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মাহিরের অবস্থা দেখে তাকে দ্রুত মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
মাহিরের মামা মোহাম্মদ রুমেল আজাদীকে জানান, শনিবার সকালে মাহিরকে আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন মাহির শ্বাস নিতে পারছিল না। তাকে শিশুদের আইসিইউতে নিয়ে যায়। ওখানে তার চিকিৎসা চলে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকলে তাকে ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়। অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকে গেলে গতকাল সকালে মাহিরের কোভিড পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। মা ও শিশু হাসপাতালেই কোভিড পরীক্ষা করানো হয়। গতকাল বিকাল চারটার দিকে মাহিরের রিপোর্ট পজিটিভ আসে।
মা ও শিশু হাসপাতালে শিশুদের জন্য ২০টি আইসিইউ রয়েছে। সেখানে গতকাল বিশ জন শিশু চিকিৎসাধীন ছিল। পজিটিভ জানার পর আইসিইউর চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসাধীন অন্য ১৯ জন শিশু এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। আইসিইউর চিকিৎসক এবং অন্য রোগীদের স্বজনদের পক্ষ থেকে মাহিরকে আলাদা করার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
কিন্তু মাহিরের অবস্থা এতই শোচনীয় যে, ওখান থেকে সরালে তার মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাহিরের মা ও মামার সাথে কথা বলেন। অন্য কোথাও তাকে স্থানান্তর করা যায় কিনা চেষ্টা করতে বলেন। মাহিরের মামা ভাগ্নেকে চমেক হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন, সেখানে মাহিরের চিকিৎসা করানোর মতো আইসিইউ সুবিধা নেই। তাকে মা ও শিশু হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আকুতি জানান।
মোহাম্মদ রুবেল আজাদীকে বলেন, মাহিরের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তার তীব্র শ্বাসকষ্ট, ভেন্টিলেশনে থাকা আমাদের দিশেহারা করে। এর মাঝে তাকে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউতে স্থানান্তরের বিষয়টি নতুন সংকটে ফেলে। আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে সাধারণ রোগাক্রান্ত শিশুদের আইসিইউ আছে। করোনা আক্রান্ত বয়স্ক রোগীদের জন্যও আইসিইউ ভেন্টিলেশন আছে। কিন্তু করোনা আক্রান্ত শিশুদের জন্য এই সুবিধা নেই।
তিনি জানান, চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি নামিদামী হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোথাও করোনা আক্রান্ত শিশুদের জন্য কোনো আইসিইউ নেই। এই অবস্থায় মা ও শিশু হাসপাতাল ভরসার নতুন ঠিকানা হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষ মাহিরকে হাসপাতাল থেকে বের না করে শিশুদের জেনারেল আইসিইউ থেকে করোনা ওয়ার্ডের আইসিইউতে নিয়ে যায়। শিশুদের আইসিইউ থেকে একটি সিটের সবকিছু খুলে নিয়ে যাওয়া হয় করোনা আক্রান্ত বড় রোগীদের আইসিইউতে। সেখানে নতুন করে শিশুদের ডাক্তারও দেওয়া হয়। সেখানেই গত রাত দশটা নাগাদ মাহিরকে স্থানান্তর করা হয়।
চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত শিশুদের আইসিইউ না থাকায় মাহিরের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছিল মন্তব্য করে রুমেল বলেন, করোনা নিয়ে এতকিছু হলো, কিন্তু শিশুদের জন্য আইসিইউ না থাকার ব্যাপারটি দুঃখজনক।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি আজাদীকে বলেন, শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম। তাদের আইসিইউ ভেন্টিলেশন পর্যন্ত যাওয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।
এই ব্যাপারে মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ফাহিম আলী রেজা গতকাল আজাদীকে বলেন, শিশুটির সমস্যা প্রকট। আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা করছি। মানবিক দিকটিও দেখছি। কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝে করোনা আক্রান্ত শিশুটিকে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এর আগে এত ছোট কোনো করোনা আক্রান্ত শিশুকে আইসিইউতে চিকিৎসা দিইনি।
মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব রেজাউল করিম আজাদ বলেন, বেশ কয়েক মাস ধরে আমরা করোনা রোগীর চিকিৎসা করছি। কিন্তু এই ধরনের অভিজ্ঞতা নতুন। এর আগে এত ছোট শিশুকে এভাবে করোনায় আক্রান্ত হতে দেখিনি। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে শিশুদের আইসিইউ আছে। কিন্তু করোনা আক্রান্ত শিশুদের জন্য নেই।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাহিরের বিষয়টি চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের নীতি নির্ধারকদের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। করোনা নিয়ে নতুন করে ভাববারও সময় এসেছে। তাদের মতে, শিশুদের করোনা আক্রান্ত হওয়া এবং তা আইসিইউ ভেন্টিলেশন পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাপারটি নতুন হুমকি তৈরি করেছে।
আইসিইউ ভেন্টিলেশন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আইসিইউ ভেন্টিলেশনের অভাবে একাধিক শিল্পপতিসহ অনেক মানুষের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা উন্মোচিত হয়েছিল। নানা উদ্যোগে সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে চট্টগ্রাম। এবার প্রকট হয়েছে করোনা আক্রান্ত শিশুদের আইসিইউ ভেন্টিলেশন সুবিধার অভাব। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।