করোনার ছোবলে প্রায় অচল বিশ্ব সচল হচ্ছে। ব্যতিক্রম কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঝুঁকির মাঝে আমাদের সন্তানদের ক্লাসে পাঠাতে চাই না। ২১ অক্টোবর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, ‘স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। ৩০ দিনে শেষ করা যায় এমন সিলেবাস তৈরি করেছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট স্কুলে জমা দেবে। সকলেই পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন পাবে।’ আমাদের ধারণা, এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে এটাই সত্য, সরকার গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও ক্ষতির পাল্লা ভারী হচ্ছে প্রতিদিন। অনিশ্চিত যাত্রায় এ সময়ে উত্তম বিকল্প আছে কি? যদি থাকে সেটি নিশ্চয় পরবর্তী শিক্ষাবর্ষেও অনিশ্চয়তা কিংবা বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দেবে।
শিক্ষাজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান। মাসের পর মাস স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে পড়ালেখা লাটে উঠেছে, ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। শিশুশিক্ষার্থীদের দুরন্তপনা আর মানসিক বিকাশ আজ অবরুদ্ধ। কিন্তু গৃহবন্দি নেই কিশোর, যুবা। বেড়ে চলছে পাড়ায়-মহল্লায় কিশোর গ্যাং ও ইভটিজিং এর দৌরাত্ম্য। নতুন বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত স্মার্টফোনের অতিব্যবহার আর অপব্যবহার, পাশাপাশি মাদক নেশায় জড়িয়ে নৈতিক অবক্ষয়ের খাদে স্বদেশ। উন্নতবিশ্ব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে শিক্ষার সমূহ ক্ষতি থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেয়েছে। পক্ষান্তরে ডিজিটাল বাংলাদেশে রয়েছে অনলাইন ফোবিয়া, নানান অজুহাত আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। তাছাড়া স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও বিদ্যুতায়নের ঘাটতি অনলাইন পরীক্ষা ও শ্রেণিকার্যক্রমের পথে অন্তরায়। ১০০% অটোপাস আর লক্ষ লক্ষ এ প্লাস নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে খুশির বন্যা বয়ে যেতে পারে। সে বন্যায় ভেসে যাবে স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর অধ্যয়নমুখী অবশিষ্ট চেতনাটুকু। পরীক্ষার টার্গেট শিক্ষার্থীকে পাঠে সম্পৃক্ত রাখে, আগ্রহ বাড়ায় শিক্ষক ও অভিভাবকের।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে শ্রেণিকক্ষে আধুনিক সুবিধা ও হাতে-কলমে শিক্ষার অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ অনুধাবন এবং পাঠের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত পাঠে অভ্যস্ত হচ্ছে না। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক না রেখে, আকর্ষণীয় পাঠ উপস্থাপনের যোগ্য শিক্ষক তৈরি না করে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা তুলে দেয়ার সাম্প্রতিক পরিকল্পনা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটিও আলোচনার দাবি রাখে। উল্লিখিত সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করতে না পেরে বিকল্প উপায় হিসেবে বছরে ৩টি সাময়িকসহ একাধিক সাপ্তাহিক/ মাসিক পরীক্ষা চালু রয়েছে।
শিক্ষার্থীকে আমরা অতিমাত্রায় পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেলেছি। অথচ শিক্ষার মূল লক্ষ্য শিখনফল, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন। পরীক্ষা তা পরিমাপের ব্যবস্থামাত্র। রাষ্ট্র শিক্ষার মানের সূচকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক শ্রেণিকার্যক্রম ও পড়ালেখার চেয়ে ফলাফলের পেছনে ছুটতে আগ্রহী। তারা শিক্ষার মানের চেয়ে পরীক্ষা কিংবা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার উপর অধিক গুরুত্ব দেয়। ফলে শিক্ষার অদৃশ্যমান ক্ষতি বর্তমানে দীর্ঘায়িত হলেও তারা ততটা সোচ্চার নন। অধিকন্তু সার্টিফিকেট নির্ভর শিক্ষায় প্রকৃত জ্ঞানার্জন, সহপাঠক্রমিক দক্ষতা ও মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অটোপাসের কল্যাণে ভর্তি পরীক্ষা নেয় না এমন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে ফেল মানের শিক্ষার্থী। এতে উচ্চশিক্ষার মান করবে আরো প্রশ্নবিদ্ধ। ভাবতে হবে, কেন বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটিও নেই।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। নীরব ঘাতকের মতো মেরুদন্ডের ক্ষয়রোধ প্রতিরোধে ব্যর্থতার চিত্র ভয়ানক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জায়গা করে নেবে মেধাহীন শিক্ষক-শাসক-বিচারক। ডাক্তারের হাতে রোগীর মৃত্যু, প্রকৌশলী দ্বারা ইমারত ধ্বংস, অর্থনীতিবিদ দ্বারা আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। নাগালের বাইরে বেড়ে যাবে সন্ত্রাস-ধর্ষণ ও দুর্নীতি। তবে- হতাশ হলে চলবে না। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনা। বীরের জাতি বাঙালি। শিক্ষাই হবে কান্ডারি।
অনেকের ধারণা জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশ। অথচ বৈশ্বিক প্রতিকূলতার মাঝেও প্রধানত কৃষিখাত, রেমিটেন্স যোদ্ধা (যদিও সিংহভাগ শ্রমজীবী ও অদক্ষ), গার্মেন্টস খাতের কল্যাণে, সর্বোপরি সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে অর্থনীতির চাকা অনেকটা সচল। জনশক্তিই এখন মূল্যবান সম্পদ। সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, ইসরাইল কিংবা জাপানের দ্রুত উত্থান বিশ্লেষণে বুঝা যায়, বিশ্বায়নের যুগে বিশাল ভূখন্ড এবং প্রচুর খনিজ সম্পদ অত্যাবশ্যকীয় নয়। সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানব সম্পদ গঠন এবং কারিগরি শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে এদেশে উন্মোচিত হবে অফুরন্ত সম্ভাবনা। যে জাতি যত শিক্ষিত তারা তত উন্নত। তাই আজ শিক্ষাতেই হোক জাতির শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ।
প্রিয় পাঠক, সংকটকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিকল্প উপায় বের করা সময়ের দাবি। আমি শ্রেণিকার্যক্রম ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরতে আগ্রহী। শিক্ষামন্ত্রণালয় সমীপে আবেদন, এ ধরণের প্রস্তাবনা পাঠাতে দেশব্যাপি উন্মুক্ত আহ্বান করা হোক। কার্যক্রম সহজ ও আকর্ষণীয় করতে জেলাভিত্তিক বাছাইকৃত রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠানো এবং জেলাভিত্তিক পুরস্কৃত করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে চূড়ান্ত নির্বাচিত প্রস্তাবনা বিশেষজ্ঞ কমিটি পরিমার্জন করবেন। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা থেকে উঠে আসতে পারে সর্বোত্তম বিকল্প। এতে জনমনে আস্থা সৃষ্টিসহ সমালোচনার পথ হবে রুদ্ধ ।
প্রস্তাবনার ১ম ধাপ- শ্রেণিকার্যক্রম :
নাগরিক সুবিধার প্রাচুর্যতায় শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি কিংবা স্ব উদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস চলছে। উদ্যোগ না নেয়া অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও এটি সম্ভব। [অপারগতায়- *পরিশিষ্ট]
পক্ষান্তরে গ্রামাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, চা দোকান ও খেলার মাঠে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শিশু-বুড়োর মাস্কহীন, ভয়হীন অবাধ বিচরণ। মাস্ক পরে গ্রামে গিয়ে হাসির পাত্রে পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতায় মনে হয় করোনার কোন বালাই নেই। তবে প্রাকৃতিকভাবে তাদের ইমিউনিটি সিস্টেম বেড়েছে। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাস্কসহ ট্রেনিং প্রদান করলে পরোক্ষভাবে ঘরে ঘরে হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি জানতে ও মানতে জনসাধারণ অভ্যস্থ হবে। ফলে করোনা প্রতিরোধে আমরা আরো একধাপ এগিয়ে যাব। অতএব শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ঐচ্ছিক রেখে, পরিমাণমত দূরত্ব বজায় রেখে শ্রেণিকার্যক্রম শুরু করতে নিচের যে কোন এক বা একাধিক নিয়ম অনুসরণ করা যায়। ক) সপ্তাহে ৩দিন ক্লাস অথবা দৈনিক শ্রেণিসংখ্যা কমানো খ) সেকশন বৃদ্ধি, গ) জোড় অথবা বিজোড় রোল অনুসারে উপস্থিতি ঘ) শিফ্ট বৃদ্ধি।
প্রস্তাবনার ২য় ধাপ- পরীক্ষা :
ক) বার্ষিক পরীক্ষা- প্রথমত: শহর এলাকায় অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দেবে শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার সব বিষয়ের উপকরণ অভিভাবক একত্রে নেবেন। লিখিত নিয়মকানুনের সাথে কিছু মনস্তাত্বিক আহ্বান জুড়ে দেয়া যায়।
[যেমন : ১। রেজাল্টে প্লেস দেয়া হবে না। পরীক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য পাঠে সম্পৃক্ত রাখা, মনোযোগ বৃদ্ধি, নিজেকে যাচাই। ২। ঘরে বসেই পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সততার শিক্ষা নেয়ার সুযোগ। অসদুপায় অবলম্বন নিজের জীবনের ক্ষতি ডেকে আনে। ৩। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ পরিবার এবং বাবা-মা সন্তানের বড় শিক্ষক। সচেতন অভিভাবক অনৈতিক সুযোগ বন্ধ রাখতে শিক্ষকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। তাছাড়া ছাড় না দেয়ার ঘোষণা আগেই জানিয়ে সন্তানকে পাঠে মনোযোগী রাখেন ]
দ্বিতীয়ত, শহর এলাকায় অনলাইন পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা [ কমপক্ষে ৩টি প্রক্রিয়া থেকে ১টি বাছাই]
তৃতীয়ত, শহর এলাকায় প্রতি শ্রেণিতে কেবল ১টি করে পরীক্ষা নেয়া (১০০ নম্বরের)। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরো প্রতিষ্ঠানে ১দিনে ১টি শ্রেণি থাকলে আসন বিন্যাসে নিরাপদ দূরত্ব রাখা যাবে। [গ্রহণযোগ্যতার ব্যাখ্যা- সরকারি স্কুল ভর্তি/ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয় সমন্বয়ে ১০০ নম্বরের ১টি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন/ বাছাই সম্ভব হয় ] প্রয়োজনে ১০০ সিকিউ, ১০০এমসিকিউ সহ ২টি পরীক্ষা ২ দিনে অথবা একই দিনে ২টি ক্লাস অথবা শিফ্ট করে পরীক্ষা নেয়া যাবে।
গ্রামাঞ্চলে তৃতীয় পদ্ধতি একই এবং প্রথম পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
খ) পাবলিক/ ভর্তি পরীক্ষা- বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মব্যস্ততা নেই। তৃতীয় পদ্ধতির আলোকে কেন্দ্রসংখ্যা বাড়িয়ে একই আয়োজনে এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি, পিইসি পরীক্ষা সম্পন্ন করলে অর্থ, সময় ও শ্রম বাঁচবে।
অন্যদিকে মেডিকেল/ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা হতে পারলে এইচএসসি পরীক্ষা হতে অসুবিধা কোথায়? কোনটি অপরিহার্য? এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ এখনো বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি (সমন্বিত/ গুচ্ছ/ ক্যাট) পদ্ধতির সঙ্গে মিল রেখে তৃতীয় পদ্ধতির আলোকে এইচএসসি পরীক্ষা হতে পারে। এইচএসসি রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হবে। উল্লেখ্য, ভর্তি পরীক্ষা অনলাইনে নেয়া যুক্তিসংগত নয়।
*পরিশিষ্ট: বার্ষিক/ পাবলিক পরীক্ষা তাড়াহুড়ো না করে জানুয়ারি মাসে হতে পারে। বার্ষিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অবস্থার বিবেচনায় গ্রাম ও শহর বিপরীত নিয়ম অনুসরণ করবে।
লেখক : অধ্যক্ষ, সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, চট্টগ্রাম।