করোনায় সংকটে শ্রমিক

মহান মে দিবস আজ, এবারও থাকছে না কর্মসূচি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১ মে, ২০২১ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

‘এই পতাকা শ্রমিকের রক্ত পতাকা/ দিক নিশানা সংগ্রামের মুক্তি পতাকা/ এই পতাকা ঐক্যের, মুক্তির ও শক্তির/ শুভ্র রাঙা বিপ্লবের অরুণ পতাকা।’
বিপ্লবী শ্রমিকের হাতুড়ির দৃঢ়তায় ঘামে ভেজা রক্তাক্ত একটি দিন আজ। আজ ১ মে, শ্রমিকের অধিকার বুঝে নেয়ার দিন। এই দিনটিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশের মেহনতি মানুষ ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে, ধর্মীয়, ভাষাগত, আচার আচরণগত ভেদাভেদ ভুলে এক পতাকাতলে এসে জড়ো হয়। সমস্বরে আওয়াজ তোলে, দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই করো। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। মে দিবসের সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেণীকে উপহার দিয়েছে সংগ্রামী লাল পতাকা ও মুষ্টিবদ্ধ হাত। শ্রমিক শ্রেণীর জন্য আজকের দিনটি তাই দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হওয়ার দিন। শেকল ছেঁড়ার দিন, উৎসবের দিন। একই সাথে শোকেরও দিন। আজ সরকারি ছুটির দিন। আজ শ্রমিকের অধিকার বুঝে নেওয়ার দিন। এমন একটি দিনে দেশ তথা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে নামা হবে না কারো। এমন দিনেও করোনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একদিকে কাজে ছুটতে হচ্ছে সেলাই দিদিমণিদের। অন্যদিকে পরিবহন শ্রমিকরা আধপেটা কিংবা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত বছর থেকে সর্বগ্রাসী এ থাবা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। এ অবস্থায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মে দিবসে গত বছরের মতো এবারও কোনো কর্মসূচি থাকছে না ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর। এদিকে মহান মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। পরিবহন শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিয়োগপত্র প্রদান, কর্মঘণ্টা ও ছুটির অধিকার আজও কার্যকর হয়নি জানিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন পূর্বাঞ্চলের সভাপতি মৃণাল চৌধুরী আজাদীকে বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের কল্যাণে এ পর্যন্ত অসংখ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তার কানাকড়িও বাস্তবায়িত হয়নি। বিএনপি সরকারের আমলে সরকারি ফান্ড থেকে দশ কোটি টাকা দিয়ে কল্যাণ ফান্ড করা হয়েছিল। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই বিগত সরকারের অনুসরণে থেমে গেছে এর কার্যক্রম। বর্তমান সময়ে কখন পরিবহন রাস্তায় নামবে তার কোনো ঠিক নেই। পরিবহন শ্রমিকদের দিন কীভাবে চলছে তার খবর নেয় না কেউ।
তিনি বলেন, এটা ঠিক, পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কিছুই নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ৭০ হাজার পরিবহন শ্রমিককে পথে পথে ঘোরা অথবা না খেয়ে মরা ছাড়া কোনো গতি নেই। দেশের অন্যতম একটি সেক্টর হিসেবে এ ব্যাপারে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
শ্রমিক নেতা মো. মুছা বলেন, শ্রেণি বিভক্ত সমাজে রক্ত ঝরা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শ্রমিক শ্রেণিকে অধিকার আদায় করে নিতে হয়। শ্রম আইন আছে, শ্রম আদালত আছে, কিন্তু শ্রমের মর্যাদা নেই। শোষক ও শোষিতের এ দ্বন্দ্ব যুগের পর যুগ ধরে চলছেই। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন শ্রমিক জনতার ঐক্য। এ ঐক্য হতে দিতে চায় না মালিক পক্ষ। তাই তারা নানা প্রলোভনে কখনো জনতাকে, কখনো আবার শ্রমিক শ্রেণীকে ভুলিয়ে ফাটল ধরাতে চায়। ইতিহাস বলে এ ধরনের চেষ্টা অতীতে বহুবার হয়েছে, তাতে পদচ্যুতিও ঘটেছে। কিন্তু পরক্ষণে বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। প্রতিরোধে চলেছে মালিক পক্ষের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস। কিন্তু একজন দুজন শ্রমিককে হয়তো দমিয়ে রাখা যায় এসবে। একটা আন্দোলনকে দমায় এমন সাধ্য কার? তবে তো আর আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতাম না।
১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে ৪ মে পর্যন্ত আমেরিকার শিকাগো শহরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে শ্রমিক শ্রেণী রচনা করেছে মে দিবসের সংগ্রামী ইতিহাস। ১৮৮৬ সালে আজকের দিনটিতে শিকাগোর ১ লক্ষ ৮৫ হাজার শ্রমিক, বিশেষ করে রাজমিস্ত্রিরা ৮ ঘণ্টা দাবি আদায় করে। ২ মে ছুটির দিন ধর্মঘট লাভ করে ব্যাপকতা। ৩ মে ম্যাক কর্মিক ফসল কাটা কারখানায় সভা চলাকালীন গুণ্ডারা আক্রমণ করলে শ্রমিকেরা প্রতিহত করে। শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ছয় শ্রমিক। আহত হয় অনেকে।
পাশে কাঠচেরাই কারখানায় আরেকটি সভায় বক্তৃতা করছিলেন শ্রমিক নেতা স্পাইজ। তিনি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাথীদের সাথে পরামর্শ করে পরদিন প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করেন। ৪ মে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের প্রতিবাদ সমাবেশ। রাত তখন ১০টা। শেষ বক্তা ফিলডেন বক্তৃতার ইতি টানছেন। ওয়ার্ড নামে একজন পুলিশ সার্জেন্ট সমাবেশ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এ সময় সমাবেশ স্থলে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুলিশের এক চর বোমাটি বিস্ফোরণ করে। সাথে সাথে নির্বিচারে শুরু হয় গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জ। ঘটনাস্থলে ৪ শ্রমিক ও ৭ পুলিশ নিহত হয়। রক্তে ভিজে যায় ‘হে’ মার্কেট চত্বর।
৩ মে পুলিশের গুলিতে এক কিশোর শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। তার সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্তে রঞ্জিত শার্টটি একটি কঞ্চিতে তুলে ধরে স্লোগান দিতে দিতে দৌড়াতে থাকে গুলিবিদ্ধ কিশোরটি। এর আগে পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর পতাকা ছিল সাদা, শান্তির প্রতীক। সেদিন থেকে কিশোরের রক্ত লাল শার্টটিকে প্রতীক হিসেবে ধরে শ্রমিক শ্রেণী লাল পতাকাকে বরণ করে নিল। ৩ মে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের গণকবর দেওয়া হয়। রাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সকালে দেখা যায় বৃষ্টির পানিতে কবরের মাটি সরে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ একটি হাত বেরিয়ে এসেছে। শ্রমিকেরা মনে করল এ মুষ্টিবদ্ধ হাত তাদেরকে সংগ্রাম না থামানোর জন্য ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সেই থেকে শ্রমিক শ্রেণী যখন কোনো সংগ্রামী শপথ গ্রহণ করে তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে শপথ করে।
বিশ্বের সকল দেশে শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয় ১৮৯০ সালে। সেই থেকে এ দিনটি শ্রমিক কৃষক মেহনতি মজদুরের দিন।
‘হে’ মার্কেটের ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হন শ্রমিক নেতা স্পাইজ ও ফিলডেন। অন্যরা আত্মগোপনে চলে যান। ঘটনার দায় চাপানো হয় শ্রমিক নেতাদের ওপর। আমেরিকার ধনিক শ্রেণীর পক্ষের আদালত সংক্ষিপ্ত ও প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসি দেয় বীর শ্রমিক নেতা পাসর্নস, স্পাইজ, ফিলডেন, মাইকেল স্কোয়ার, জর্জ এঙ্গেলস ও অ্যাডলফ ফিসারকে। ২২ বছর বয়সী শ্রমিক নেতা লিংগকে হত্যা করা হয় কারাভ্যন্তরে। সবচেয়ে কম বয়সী শ্রমিক নেতা অস্কার নিবেকে দেওয়া হয় ১৫ বছরের কারাদণ্ড। ১৮৮৮ সালে আবারো ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই ১ মে-তেই আন্দোলনের সূচনা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতদন্তে প্রমাণ পেলে তবে আনভীরকে গ্রেপ্তার : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধরোগী-ডাক্তার উভয়ের জন্যই আশীর্বাদ