ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১’ নামের এই রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই রিপোর্ট অনুযায়ী আর ৭ বছর পর চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে যাবে ২৫ নম্বরে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক উলট-পালট ঘটে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বেশিরভাগ বড় অর্থনীতির দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিপরীতে চীন কৌশলে করোনা দ্রুত এবং কঠোরভাবে মোকাবেলার কারণে সামনের বছরগুলোতে পৌঁছে যাবে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময়। বাড়ছে দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) পরিমাণ, বাড়ছে অর্থনীতির আকার। পাকিস্তানি দুঃশাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর মাত্র কয়েক কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যে ছোট অর্থনীতির দেশটি, সেই দেশের বাজেট আজ পাঁচ লাখ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ছোট্ট অর্থনীতির দেশটি আজ পরিচিতি পেয়েছে এশিয়ার ‘টাইগার ইকোনমি’ হিসেবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যেকোনো সূচকের বিচারে গত দুই দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অভূতপূর্ব। সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার কমেছে। মেয়েদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে। জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকেও পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।
অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের তত্ত্বমত উপস্থাপন করে বলেন, প্রথম সহজলভ্য উপকরণনির্ভর শিল্প হিসেবে এদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থান হয়েছে। দেশে ছোটোখাটো একটা শিল্প বিপ্লব ঘটেছে। এ খাত থেকে জিডিপির ৩০ ভাগ এলেও অসীম শ্রম যোগানের বিপরীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তা অপ্রতুল। তবে উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপে মানব-মূলধননির্ভর প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা নিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসার জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ পত্রিকান্তরে বলেন, আজকে বাংলাদেশ যে পর্যায়ে এসেছে, তা অত্যন্ত সন্তোষজনক একটা পর্যায়। আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক। প্রবাসী আয়প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতিও সহনীয়। দুটি নির্দেশক ভালো। আমরা উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছি, আবার নিম্নমধ্যম আয়ের দেশেও পৌঁছেছি। নির্দেশকগুলো অবশ্যই ভালো। কিন্তু ৪৯ বছর লেগেছে। এটা একটা দুঃখের ব্যাপার। এখন আর দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা যাবে না। দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে হবে। এটিই আমার মতে সবচেয়ে মূল চ্যালেঞ্জ। এতটা অর্জনের পথে যে আমরা হাঁটতে পেরেছি, তাতে বেশি অবদান হলো আমাদের সাধারণ মানুষের। তাদের কর্মপ্রেরণা ও উদ্যোগ। আমি অনেক সময় বলি, সরকার আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখুক। ব্যক্তি খাত ও সাধারণ মানুষ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কৃষকরা আজকে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা নিশ্চিত করেছেন। চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করা যাক। একটি হলো, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কম। এটি বাড়াতে হবে। ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯-১০ শতাংশ থাকলে সেটি বোধ হয় মঙ্গলজনক কিছু নয়। বলা হচ্ছে, সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনা হলো। শুধু সুদহার কমালেই কিন্তু হবে না। সুদহারের সঙ্গে অন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে।
করোনার মধ্যেও যে বাংলাদেশ কিছুটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে, তা বিস্ময়কর। তাই সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধারাবাহিক এবং জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করা হয়েছে।