ডিসেম্বর ২০১৯, চীনের উহান সিটি থেকে উৎসারিত করোনা অতিমারি বছর ঘুরে এখনো প্রবল পরাক্রমে প্রলয় নাচন নেচে চলেছে মানবকুলে। মৃত্যুদূত যেন প্রতিদিন হেসে হেসে ধরিত্রী কানন হতে তুলে নিচ্ছে হাজার হাজার মনোহর মানব-ফুল। দিন গুণে গুণে হাতে জীবন-আয়ু নিয়ে যেন সময় পার করতে হচ্ছে পৃথিবী-বাসীকে।
কোভিড-সার্স-২ ভাইরাস, তার বেঁচে থাকা ও উন্মক্ত ছুটে চলার প্রয়োজনে ইতোমধ্যে হাজার হাজার রূপ পরিবর্তন করেছে। পরিবর্তন হয় মুকুটের কাঁটাতে-স্পাইক প্রোটিনে, যার দ্বারা ভাইরাস জীবাণু সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে শরীর কোষে আটকে থাকতে পারে। আর এইসব নতুন নতুন মিউটেশান বা রূপ পরিবর্তন তৈরি করছে রোগের বৈশ্বিক নতুন ঢেউ, কখনো কখনো তা অধিক সংক্রামক ও প্রাণঘাতী হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। ২০২০ এর মার্চে দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়েছিল। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুটোই গ্রাফের তলানিতে নেমে এসেছিল। দেশের মানুষ যখন এই মারণঘাতী ছোবল থেকে মুক্তির আশায় বিভোর, গা ভাসিয়েছে শৈথিল্যে, তখন থেকে আবার শুরু-করোনা তাণ্ডব। অবশ্য বিশ্বের বহু দেশে এরিমধ্যে তৃতীয় বা চতুর্থ করোনা ঢেউ প্রবাহ আঘাত হানছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনা অতিমারি হতে মানবকুল রক্ষার জন্য নিরলস গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। রোগ প্রতিরোধের উপায়, কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার ইত্যাদি নিয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল যোগাড় করছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো-দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনা প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার।
বর্তমানে কোভিড-১৯, ভাইরাসের যেসব রূপান্তর রোগের নতুন ঢেউ বয়ে এনেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-১. ইউ.কে বা কেন্ট স্ট্রেইন ( বি-১.১.৭), ২. আফ্রিকান স্ট্রেইন (বি-৫৩১), ৩. পি.১। ইউ.কে স্ট্রেইন শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে আফ্রিকা থেকে সাউথ লন্ডনে আসা এক ব্যক্তির মাধ্যমে। ইতোমধ্যে যা বিশ্বের ৫০টা দেশে ছড়িয়ে গেছে। আফ্রিকান স্ট্রেইন শুরু তার পরের মাসে,অক্টোবরে। প্রথম দিকের করোনা ভাইরাস একজন থেকে তিনজনে ছড়াতো, কিন্তু এই প্রজাতি একজন থেকে একসাথে দশজনে ছড়াতে সক্ষম, সাথে এর ছোবলে মৃত্যুহার প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ বেশি। অনেক আই.সি.ইউ স্পেশালিস্ট বলছেন এই ধরনের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আই.সি.ইউ-ও রোগী ও ক্ষেত্রে আগের অভিজ্ঞতায় ব্যবহৃত ওষুধ তেমন কার্যকর বলে মনে হচ্ছে না।
উন্নত দেশসমূহ সহ পৃথিবীর অনেক দেশ এরুপ অতি সংক্রামক করোনা থাবায় একসংগে আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক রোগীর বেড সংকুলান, ওষুধ এবং ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে জড়ভরত অবস্থায় পতিত হয়েছে। সুতরাং করোনা ট্রান্সমিশান চেইন ভেঙে দেয়াসহ সবকিছু মিলিয়ে করোনা মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের অধুনা ব্যবস্থাপত্র হলো নিম্নরূপ-
১, এম.মাস্ক -যথাযথভাবে মাস্ক পরা। উপসর্গহীন অনেক করোনা রোগী আছেন, যারা মাস্ক না পরার কারণে নিজের অজান্তে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছেন। তাই ঘরের বাইরে এলে সবাই যেন নিজের, পরিবারের ও সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য অবশ্যই মাস্ক পরেন। এ ব্যাপারে যেন প্রত্যেকে প্রত্যেককে উদ্বুদ্ধ করেন- কোনো ছাড় না দেন। সাথে ২ গজ সামাজিক দূরত্ব ও হ্যান্ড স্যানিটাইজেশান।
২.টি. টেস্ট-রোগ উপসর্গ নিয়ে সন্দিহান হলে চিকিৎসক পরামর্শ নিয়ে দ্রুত টেস্ট করানো ।
৩. টি. ট্রেসিং- রোগীর সংসর্গে যারা এসেছে, তাদের শনাক্তকরণ। বলা হয় একজন আক্রান্ত রোগীর জন্য কমপক্ষে ৩০ জন সংসর্গের নমুনা পরীক্ষা করানো উচিত।
৪. টি. ট্রিটমেন্ট-রোগীর যথাযথ চিকিৎসা ও আইসোলেশন।
৫. ভি.ভ্যাকসিন- কোনো দেশের ৬০-৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে করোনা টিকা দেওয়া গেলে, সেই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক শক্তি ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়। বাংলাদেশের খ্যাতনামা জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী অধ্যাপক মোজাহেরুল স্যারের অভিমত-বাংলাদেশে ১২.৫ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে করোনা টিকা দেওয়া গেলে কেবল আমাদের দেশে এই হার্ড ইমিউনিটি অজর্ন করা যাবে।
এই প্রসংগে বলা যায় করোনা প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ নিয়ে অনেক দেশবাসীর মনে দোলাচল রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কোনো টিকা কারো জন্য শতভাগ কার্যকর বা নিরাপদ থাকে না। দেশে ব্যবহৃত অ্যাস্টোজেনিকা-অঙফোর্ড ভ্যাকসিনও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতি দশলাখে ৪ জনে মস্তিষ্কে রক্তজমাট, কিংবা একজনের মৃত্যু টিকাকরণ থেকে ঘটছে বলে গবেষণা তথ্য বেরিয়েছে। কিন্তু টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে এই টিকার প্রায় ৭০ শতাংশ জনে কার্যকারিতা,ও প্রায় ৬০ শতাংশ জনে ইউ.কে স্ট্রেইন সহ মিউটেন্ট স্ট্রেনের বিরুদ্ধে এর কার্যকর ভূমিকা প্রমাণিত। তাছাড়া এই ভ্যাকসিন সৃষ্ট রোগপ্রতিরোধী ‘টি-সেল মেমোরী সেল’ উদ্দীপিত করতে এটা ফাইজার করোনা ভ্যাকসিনের চেয়ে তিনগুণ বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত-যদিয়ো ফাইজার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯২ শতাংশ বলে উল্লেখিত। একথা জেনে রাখা ভালো স্টেরয়েড পিল ও এই অসুখে পড়ে প্রাণসংশয় কিংবা মস্তিষ্কের রক্তজমাট বাঁধাজনিত যে প্রতিক্রিয়া, তা টিকাকরণের প্রতিক্রিয়ার তুলনায় অনেক বেশি।
কাজেই টিকাদানে সক্ষম দেশের সকল নাগরিক যেন দ্বিধাহীন-চিত্তে টিকাকরণ উৎসবে যোগদান করেন ও সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। নিজের সুরক্ষা ও বাংলাদেশকে করোনা মোকাবিলা যুদ্ধে বিজয়ী হতে এর বিকল্প কিছু নেই।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।