সর্বত্র হাহাকার। হাসপাতালে ভর্তির জন্য হাহাকার যেমন, তেমন ভর্তিকৃত রোগীদের হাহাকার আইসিইউ’র জন্য। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরেও মিলছে না সিট। কোথাও শয্যা খালি নাই। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এম্বুলেন্স নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত রোগীর স্বজনরা। আবার শয্যা পাওয়ার আগেই অনেক রোগী এম্বুলেন্সেই মারা যাচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অসহায়। শয্যা দিতে না পেরে তাদেরও মনে হাহাকার। চোখের সামনে রোগীর করুণ আকুতি তাদের হৃদয়কেও তছনছ করে দিচ্ছে। কিন্তু কিছুই যে করার নেই। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়বহুল সেবাও নিতে পারছেন না বেশির ভাগ মানুষ। বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডেও ১০-১২ দিন করোনা চিকিৎসা নিলে বড় অঙ্কের বিল আসছে। গরিব অসহায় রোগীর জন্য এ অর্থ ব্যয় করা দুঃসাধ্য। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংক্রমণ বাড়ায় রোগীদের অবস্থা জটিল হচ্ছে। রোগীরা হাসপাতালমুখী হওয়ায় সব ধরনের শয্যা সংকট তৈরি হয়েছে।
এদিকে করোনার চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধপত্রের মূল্য অস্বাভাবিক। ফলে সবার পক্ষে এসব ওষুধ গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেননা তা মোটেই সহজলভ্য নয়। গতকাল ২০ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, করোনার ওষুধ সহজলভ্য হোক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কোভিড রোগীর চিকিৎসার বাস্তব দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জটিল অবস্থায় পড়া কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় সুইজারল্যান্ডের রোচ কোম্পানির তৈরি বিশেষ দুটি ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এ্যাক্টেমেরা নামের এই ইনজেকশনের ৪০০ এমজির দাম ৪৩ হাজার টাকা, ২০০ এমজির দাম ২১ হাজার ৫শ টাকা। রেডিয়েন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড সুইজারল্যান্ড থেকে এই ওষুধ আমদানি করে। চিকিৎসকদের প্রথম পছন্দ এ্যাক্টেমেরা হলেও রেডিয়েন্ট তা যোগান দিতে পারে না। দেশে কোথাও স্বাভাবিকভাবে এ্যাক্টেমেরা ইনজেকশন পাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের একই কোম্পানির তৈরি এবং বাংলাদেশেও একই কোম্পানির আমদানিকৃত এভাসটিন ইনজেকশন পাওয়া যায়। তবে তাও সহজপ্রাপ্য নয়। নানা তদবির ও চেষ্টায় জোগাড় করতে হয় দামি এই ইনজেকশন। ৪০০ এমজির প্রতিটি ইনজেকশনের দাম ৭৮ হাজার টাকা, ১০০ এমজির দাম ২০ হাজার টাকা। শারীরিক ওজন হিসেব করে প্রয়োগ করা হয় এভাসটিন। কাউকে একটি, কাউকে দুটি। এক্ষেত্রে এভাসটিন ইনজেকশন দিতে মোটামুটি ওজনের একজন মানুষের খরচ হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এতে আরো বলা হয়েছে, শুধু এভাসটিন দিয়ে চিকিৎসা হয় না। রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে সেজন্য নাভিতে সকাল-সন্ধ্যা দেশি-বিদেশি ইনজেকশন পুশ করা হয়। একেকটি ইনজেকশনের দাম ৫/৭শ টাকা। একজন রোগীকে ২৫/৩০টি ইনজেকশন দিতে যে পরিমাণ খরচ হয় তা জোগাড় করার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই। শুধু কি ইনজেকশন? সাথে আইসিইউ, অক্সিজেন বিল, বিভিন্ন টেস্ট ও অন্যান্য খরচ মিলে যে অংক দাঁড়ায় তা বহন করা কঠিন। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হলেও আনুষঙ্গিক অনেক খরচ রোগীকে বহন করতে হয়। প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে করোনার ওষুধ সহজলভ্য করার আবেদন জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষের জন্য উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, কিন্তু করোনার ওষুধ সহজলভ্য এবং সস্তা করে মানুষ বাঁচানো আরো বেশি দরকার।
বিশ্বের খ্যাতিমান মানব উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সাকিকো ফুকুদা-পার বলেছেন, ওষুধ উদ্ভাবন ও ওষুধের সহজলভ্যতা একুশ শতকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক বাণিজ্য চুক্তি থাকার পরও বিশ্বব্যাপী ওষুধের দাম আকাশচুম্বী। ওষুধ সহজলভ্য না হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জিত হবে না। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশের মতো উচ্চ আয়ের দেশের মানুষও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার বিবেচনা করে ওষুধ উদ্ভাবনেও বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত। জন অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় ওষুধের সহজলভ্যতা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
এ কথা মানতেই হবে যে, স্বাস্থ্য অন্য অনেক বিষয়ের চেয়ে আলাদা। আন্তর্জাতিক আলোচনা বা দলিলে স্বাস্থ্যকে ‘বৈশ্বিক গণপণ্য’ (গ্লোবাল পাবলিক গুডস) হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এজন্য ক্যানসারের মতো রোগের ওষুধ এবং করোনার ওষুধ সহজলভ্য করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এ কথা স্বীকার্য যে, সরকার নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। তাছাড়া, কোভিড টেস্ট থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন প্রদানে অনন্য ভূমিকা পালন করছে সরকার। এসব বিবেচনায় রেখেও আমরা করোনা চিকিৎসায় ওষুধের সহজলভ্যতার জন্য সরকারের কাছে আরো বেশি ভর্তুকি প্রত্যাশা করছি। প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহে যে কোনও সম্ভাব্য বিঘ্ন মোকাবেলায় ‘সময়োপযোগী এবং কার্যকর’ ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনগণকে আশ্বস্ত করা দরকার। কোভিড -১৯ মহামারিতে ওষুধের যথাযথ দামের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে আমরা মনে করি।