করোনাকালে শেষ যাত্রার সঙ্গী

অভীক ওসমান | শনিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে : হাসপাতালে করোনায় মৃত বাবার কাছে যাচ্ছে না সন্তান। বাবার লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে সন্তান, পরিবার, পরিজন। এটি চট্টগ্রামের সেকেন্ড ওয়েভের সামপ্রতিক উদাহরণ। ঢাকার একটি সংবাদ হলো ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ উত্তোলন করে বাবার পেনশন তোলার প্রক্রিয়া করছে সন্তান। নোভেল কোভিড-১৯ আমাদের এ ধরনের মর্মবিদায়ী সংবাদ দিচ্ছে। অথচ মুদ্রার অপর পিঠে ২০২০ এর তথ্য হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল থেকে কুয়েত মৈত্রীতে নেবার জন্য এ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করতে না পেরে বাবা ছেলেকে কাঁধে তুলে বললেন, ‘দেশ মইরা গেছে, তোর বাপতো আছি।’
কিন্তু অতিমারীর এই মরণের মিছিলে সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছে মানবিক সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। ২০২০ এর শুরুর দিকে এই গাউসিয়া কমিটিসহ, মানহিল, নিষ্ঠা ফাউন্ডেশন নিয়ে লিখেছিলাম। তখন ১৯ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত সমস্ত দেশে সর্বমোট মৃতের সংখ্যা ছিলো ১০০। কিন্তু ২০২১ এর সেকেন্ড ওয়েভে গড়ে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০। মহামরণের মহাসংকটের মুখে আমার দেশ ও নিখিল দুনিয়া।
নিজের জীবন দিয়ে দেখা : ২০২০ এর শুরুতে আমি আমার সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে লিখেছিলাম। ২০২১ সালে আমি ও আমার পরিবার করোনাক্রান্ত হয়ে বুঝেছি- এটি জীবনমরণ একটি যুদ্ধ। আল্লাহর অশেষ নেয়ামত আমরা এখনো সুস্থ আছি। ‘ফাবি আইয়্যে আলায়ে রাব্বিকুমা তুকাজ্জীবান’। আল্লাহর সকল নেয়ামতকে আমরা কবুল করি। কিন্তু ৮ এপ্রিল আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই, লেখক এমরান চৌধুরীর স্ত্রী ফাতেমা বেগম চৌধুরী দীর্ঘ ২৪ দিন আইসিইউ থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন গাউসিয়া কমিটির দাফন বন্ধুর সেবা আমি চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করেছি।
গাউসিয়া কমিটির সেন্ট্রাল জয়েন্ট সেক্রেটারী ফোন করলে জানালেন- আপনার মহিলা মুর্দা গোসল-কাফন প্রক্রিয়া চলছে মহানগরের টিমের মাধ্যমে। এরপর চন্দনাইশ টিম টেকওভার করবে। চন্দনাইশ বরমা-বরকল সড়কের আব্দুল্লার মসজিদে আমাদের গোরস্থানে আমি পৌঁছার আগেই তাদের এ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে গেছে। জোহরের নামাযের পরে পিপিই পরে সবাই দাফনের জন্য রেডি। এর নেতৃত্বে ছিলেন চন্দনাইশ টিম প্রধান ও দু’দুবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা সোলাইমান ফারুকী। মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে অত্যন্ত দক্ষভাবে তারা আমাদের ছোট বোন তুল্য বাড়ির সেজ বৌয়ের দাফন সম্পন্ন করলো। তাদের এই কর্ম তৎপরতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর : সবচেয়ে প্রীত বোধ করেছি মুর্দা গোসলকারী কাফন পড়ানোর কাজে নিয়োজিত তরুণী জামেয়ার কামেল ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স করা আনোয়ার আমিন মিকা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বেওয়ারিশ মহিলা মুর্দার লাশ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা আমার সহ্য হয়নি। পরিত্যক্ত লাশ বা যে কোন মা বোনের লাশ আমরা গোসল দিয়ে থাকি ও কাফন পরাই। এরপর আমাদের পুরুষ সতীর্থগণ এম্বুলেন্সে করে নিয়ে গিয়ে দাফন করে আসে। এব্যাপারে আমার পরিবার সহযোগিতা করেছে এবং আমার করোনা তো দূরে থাক সর্দি কাশি জ্বর ও হয়নি’। আরেক জন আলেম পত্নী বলেছেন, ঘরে আমার শিশু আছে। এরপরেও আমি মহিলাদের গোসল ও কাফন পড়াচ্ছি। আলহামদুদলিল্লাহ। বেকসুকা সাহারা হামার নবী।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হচ্ছে, ‘তুমি কেবল সতর্ক করতে পারো, তাহাদেরকে যারা উপদেশ মেনে চলে আর করুণাময়কে না দেখেও ভয় করে। তাদেরকে সুখবর দাও ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের’। –৩৬ সূরা ইয়াসিনঃ ১-১১। কোরআন সূত্র : (মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান পৃঃ৪৯৯) এর অনুরণনে আলা হযরত আহমদ রেজা খান ব্রেলভী (রঃ আঃ) এর একটি নাত–
গমজাদো কো রেজা মোজাদ্দেদ যে কহে/ বেকসুঁকা সাহারা হামারা নবী। অসহায় মানুষেরে দাও খোশখবর/ বেহাল মানুষের সাহারা নবীয় আমার (অনুবাদ)
তথ্যসূত্র জানাচ্ছে বার্মায় আনজুমানে শুরাহ এ রহমানিয়া (১৯২৫) সংগঠন ছিল। ১৯৩৭ এর চট্টগ্রাম শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে আনজুমানে আহমদিয়া সুন্নিয়া সংগঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে এসে দুটি সংগঠন একীভূত হয়ে বর্তমান আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া রূপলাভ করে। আজাদী সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মালেক এর সাথে সামপ্রতিক কথোপকথনে জানা যায়, ১৯৪৬ এর দিকে তার পিতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চিটাগাং আরবান কোঅপারেটিভ এর তৎকালীন সেক্রেটারী আবদুল জলিল ও হালিশহরস্থ বস্ত্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবুল বশরের সহযোগিতায় হযরত সৈয়দ আহমদ ছিরিকোটি (রাঃ আঃ) কে চট্টগ্রাম আনেন। হুজুর বয়ান করেছিলান, ‘মুঝে দেখনা চাহিয়ে তো মাদ্রাসাকে দেখো’। খোয়াব হচ্ছে আমাদের ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা। এর পরিচালনায় আছেন- আ্‌নজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। তাদেরই অংগ সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ (১৯৮৬)।
কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় তাদের কার্যকলাপ আগামী নিউনরমাল ইতিহাসে স্মরণীয় ও অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনা পরিস্থিতিতে সারাদেশে ত্রাণ সহায়তা ও করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের কাফন-দাফন ও সৎকার কার্যক্রম, করোনা রোগীদের জন্য আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ, করোনা রোগীদের অঙিজেন ও এম্বুল্যান্স সহায়তায় কাজ করছে। কাফন-দাফনে কাজ করছে সংগঠনটির দুই সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক।
তাদের যতো কার্যক্রম : গত ২১ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১,৯৬৪ জন এবং সারাদেশে ২,৩৮৯ জনকে দাফন সহায়তা দিয়েছে। এর বাইরে ২৯ জন হিন্দু, ৩ জন বৌদ্ধকে সৎকারে সেবা দিয়েছে। আমাদের দাফন-কাফন সেবা পাওয়ার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৩৫ জন, অজ্ঞাত পরিচয়ের মরদেহ ছিল ১৩ জন। অঙিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৮৬৭ জনকে। অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহন সেবা দেওয়া হয়েছে ২,৭২২ জনকে। ভ্রাম্যমাণ কোভিড টেস্ট সুবিধা পাচ্ছে দৈনিক ৩০ জন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন : গত ৫ ডিসেম্বর ২০২০ শহিদ বুদ্ধিজীবী অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়ন প্রফুল্ল রঞ্জন সিনহা (৮০) কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৎকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পাশাপাশি সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির অনন্য এক নজিরের মাধ্যমে মানবতাবাদী মানুষ লায়ন প্রফুল্ল রঞ্জন সিনহাকে শেষ বিদায় জানানো হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মানবতাবাদী মানুষ লায়ন পিআর সিনহার মরদেহ সৎকারের পুরো কাজটিই গাউসিয়া কমিটি সম্পন্ন করেছে। গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবকেরা মৃতদেহ গোসল করানোর পর ধর্মীয় আচারের জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রদান করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি শেষে মরদেহ খাটিয়ায় তুলে গাউসিয়া কমিটির সদস্যরাই বাড়ির পূর্ব পাশের চিতায় নিয়ে যান। সেখানে পরিবারের সদস্যরা অন্যান্য আয়োজন সম্পন্ন করে।
১১ জুন ২০২০ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান সুব্রত বিকাশ বড়ুয়া (৬৭) নামের এক বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হয় গাউসিয়া কমিটির। লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, গোসল দেওয়া থেকে শুরু করে শেষকৃত্যের সব কাজ করেন এই সংগঠনের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া শাখার কর্মীরা। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে এভাবে দিন-রাত করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকারে ছুটে চলেন তাঁরা।
সেকেন্ড ওয়েভের কার্যক্রম : করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নগরে আবার চালু হয়েছে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ করোনা স্যাম্পল কালেকশন ও টেস্ট সেবা। কাফন-দাফন ছাড়াও ফ্রি অঙিজেন সাপ্লাই, গরিবদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, ফ্রি ট্রিটমেন্ট ক্যাম্প, ওষুধ বিতরণ, ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ সেবামূলক সব কর্মসূচি জনগণের স্বার্থে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ২০২০ সালে প্রথম লকডাউন সময়ে ১ লাখ অসহায় পরিবারকে সহায়তার পর দ্বিতীয় লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দেড় লাখ পরিবারকে ইফতার ও সেহেরি সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছিল মানবিক সংগঠন। গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র উদ্যোগে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। একশর বেশি সিলিন্ডারে অঙিজেন সেবা পেয়েছেন ১২ হাজার ৫৫০ জন। এছাড়া ২ হাজার ১০০ জনের বেশি রোগী পেয়েছেন অ্যাম্বুল্যান্স সেবা। ১১ হাজার রোগীকে ওষুধ সামগ্রী ও এক লাখ পরিবারের কাছে পৌঁছানো হয়েছে খাদ্যসামগ্রী।
করোনার জন্য চট্টগ্রামে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল : হাসপাতাল সেবার অপ্রতুলতার কথা এখন সর্বজনবিদিত। ফার্স্ট ওয়েভে কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল, আইসোলেশন সেন্টার, স্থাপিত হয়েছিল। ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া আরও একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল স্থাপন করছেন। গত ৮ মার্চ ২০২১ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সবার জন্য আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ।এক একর জায়গায় ১৫০ শয্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। মূল সংগঠন আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ট্রাস্টের উদ্যোগে এ হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। যেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সেবা উন্মুক্ত থাকবে।
সবিনয় নিবেদন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী : নন পার্টিজান কিন্তু ধর্মাচারী আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট করোনা রোগীদের জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। আনজুমানের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মহসীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আকুল আবেদন জানিয়ে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দাফনকারী গাউসিয়া কমিটিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় একখন্ড ভূমি দেয়া হোক। ভূমি মন্ত্রী ও ট্রেড বডি নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমপি মহোদয়ের নিকটও সবিনয় নিবেদন করেন। রেল মন্ত্রী মহোদয়, রেল বিষয়ক স্থায়ী কমটির চেয়ারম্যান এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। আমাদের দেশের বিত্তবান ব্যবসায়ীগণ ও প্রাইভেট সেক্টর এগিয়ে আসতে পারেন।

লেখক : চট্টগ্রাম চেম্বার সাবেক সচিব
চবির নাট্যকলার অতিথি শিক্ষক, উন্নয়ন সংগঠক ও বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মত্যাগের বিস্মৃত কাহিনি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে