করোনাকালীন এক সফল অর্থমন্ত্রী

ডিশি রিশি

নুজহাত নূর সাদিয়া | শনিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

ধারাল নাক আর কিছুটা চৌকোণা মুখের মানুষটির তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি আর বুদ্ধিদীপ্ত হাসিটি সহস্র মানুষের ভিড়ে ও নজর কাড়ে। তবে, সুদর্শন মানুষটির নজরকাড়া চেহারাটি সাধারণের আলোচনার মূখ্য বিষয় নয়, যে বিষয়টি ব্রিটিশ জনতা ও সেই সাথে বর্তমানে তাবত পৃথিবীর বোদ্ধা রাষ্ট্রপ্রধানদের বারে বারে বিস্মিত করছে এ করোনাকালীন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর অভিনব সব পরিকল্পনার বাস্তব সম্মত প্রয়োগ। অভিবাসীর পরিচয়টি পৈতৃক সূত্রে রক্তে বহমান,তবে জন্মসূত্রে ব্রিটিশ মানুষটি তার ঐতিহ্যগত ধর্ম বিশ্বাসের উপর আজ ও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে আছেন। তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে চটপটে মানুষটি ‘ভগবত গীতা’ পাঠের মাধ্যমেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুভ সূচনা করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, শত বছরের পুরনো অভিজাত ‘রিচমন্ড’ এলাকার আসনটি কনজারভেটিভ পার্টির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত, সে আসনটিতে প্রথম বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাজিমাত করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি এ ভারতীয় সন্তানটির। ২০১৫ সালে প্রায় ৩৬.২% মেজরিটি নিয়ে এ পাঞ্জাব বাজিকরটি জীবনের প্রথম রাজনৈতিক বাজিটি জিতেছিলেন। সময় তার ক্ষণজন্মা পুরুষটির দিকে দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছিল, তবে ধীমান রিশি অনাবাসীদের ভিনদেশে শেকড় খুঁজে ফেরার সংগ্রামটি সেই শৈশবেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। হয়তবা, চিকিৎসক বাবার সূত্রে কেনিয়া আর ফার্মাসিস্ট মা’র সূত্রে তানজানিয়ায় আবাস গাড়া কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের দু:খগাথা তাঁকে ছুঁয়েছিল। আর তাই, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার সাথে সাথে কালো এবং অনাবাসীদের গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। পথচলা শুরু, সংসদে গৌরবময় অভিষেক ঘটল পরিবেশ, খাদ্য ও রাজধানীর বাইরের শহরগুলোর নানা সমস্যার উপর আলোকপাতের মাধ্যমে। আগেই বলেছি, সৌভাগ্যের বরপুত্র আর সে সৌভাগ্যের সাথে যদি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত মেধার যথার্থ সম্মিলন ঘটে , তবে সে উদীয়মানের অগ্রযাত্রা ঠেকায় কে? ২০১৭, ২০১৯ সাল নির্বাচনে জয়ী তরুণটির রাজনৈতিক পথচলা যথেষ্ট মসৃণ, পুরোপুরি মন দিলেন নিজ দলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ব্রেঙিট সমর্থনে জোর প্রচারণায়। উত্তর সুরি বিতর্কিত সাজিদ জাভেদের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন ট্রেজারিতে। কোষাগারের স্পর্শকাতর রক্ষণাবেক্ষণ, সাজিদ জাভেদের সমালোচিত সিদ্ধান্ত সমূহ অপরদিকে, বরিসের একান্ত অনুগত ডমিনিকের নি:শর্ত সমর্থন, কোষাগারের প্রধান সচিবের পদোন্নতি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। চলতি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু হল নতুন অর্থমন্ত্রীটির। সপ্তাহ না ঘুরতেই, সময়ের সবচেয়ে বড় অগ্নিপরীক্ষাটির সম্মুখীন সুনাক, করোনা নামক সে ক্রান্তিকালে বীরের মতই ঘুরে দাঁড়ালেন এই সাহসী যুবাপুরুষটি। অধিবাসীদের ক্ষমতাসীন টোরি দল প্রকৃত মূল্যায়ন করে না, নিন্দুকদের এই আপ্ত বাক্যকে ভুল প্রমাণিত করে সম্পূর্ণ নিজ মেধা আর ইচ্ছেশক্তিকে পুঁজি করে এটাই প্রমাণ করলেন প্রকৃত গুণীর কদর পাগলাটে প্রধানমন্ত্রী বরিস ও করতে জানেন। বরিস ও ডমিনিকের সময়োচিত সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তা প্রমাণার্থে সুনাক ১ম বারের মত ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের এক বাজেট পেশ করলেন যার মধ্যে অতিরিক্ত ১২ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ ছিল যা করোনা কালে বিপর্যস্ত অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখতে রিশি বরাদ্দ করেছিলেন। অর্থনীতির চুল চেরা বিশ্লেষণ নয়, ঐতিহাসিকভাবেই সমাদৃত ইংল্যান্ডের জনকল্যাণ সিস্টেমকে সম্মান জানিয়ে ৩৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের এক বিশাল বাজেট পেশ করলেন যা পুরো বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিগত অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ চরম চাকরি সংকটের বাজারে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন চাকরিজীবীকে ‘ফারলো স্কীমের’ আওতায় এনে আর্থিক সংকটে পড়া বহু পরিবারকে এখন ও বেঁচে থাকার আশ্বাস যুগিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ব্রিটেন ২য় জাতীয় লকডাউনের অবরুদ্ধ সময়টিতে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে, আসন্ন ২০২১ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ পুরো ইউরোপ জুঁড়ে কনকনে শীতের সে হাঁড় কাঁপানো অনুভব আর মহামারির তীব্রতা পাল্লা দিয়ে বেঁড়েই যাবে, এ বাস্তবভিক্তিক আশংকাই প্রকাশ করেছেন দায়িত্বরত বিজ্ঞানীরা। আর এ কঠিন সময়ের সাথে এক দারুণ সন্ধি স্থাপন করেছেন দয়ালু হৃদয়ের রিশি। মন্থর অর্থনীতি আর স্থবির জীবনযাত্রাকে সচল রাখার অভিপ্রায়, বাড়িয়ে দিয়েছেন ‘ফারলো স্কীমের’ সময় সীমা আগামী ২০২১ সালের মার্চ মাসের শেষ নাগাদ।
স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলব্রাইট স্কলারটি কর্মজীবনের শুরতে ‘ইনভেস্টম্যান্ট ব্যাংকে’ একজন এনালিস্ট হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনার নানা খাতে তাঁর পেশাগত দক্ষতার হাতটি ক্রমশ প্রসারিত হতে লাগল। ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ের প্রজাপতিটি ও তার বর্ণিল রঙে তাঁর জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি ভারতীয় ধনকুবের নারায়ন মিত্রের কন্যা অশ্বেতা মিত্রকে ভালবেসে বিয়ে করে সুখী সংসারে দু’টি সন্তানের জনক রিশি। সংসার জীবনে দায়িত্বশীল পিতা, বাস্তব জীবনে প্রেমময় স্বামীটি শ্বশুরের মালিকানাধীন ‘ক্যাটামারান’ কোম্পানির একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বটে।
ব্যবসায়িক বোদ্ধা না রাজনীতির নব্য গুরু কোন পরিচয়ে রিশি অলঙ্কৃত হবেন তা ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। তবে, বর্তমানে ‘ডিশি রিশি’ পরিচয়ে দারুণ ভাবে জনপ্রিয় মানুষটির ইট আউট হেল্প আউট স্কীমটি (অর্থাৎ, শতকরা ৫০ ভাগ দামে রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার সরবরাহ করা) নির্দিষ্ট সময় শেষে ব্যক্তি মালিকানাধীন রেস্তোরাঁগুলোতে প্রবল প্রতাপেই রাজত্ব করছে।
পাকা রাঁধুনির মতই হেশেল সামাল দিয়ে চলেছেন রিশি, তবে সুদূরপ্রসারী মানুষটি বেশ ভালভাবেই অনুভব করছেন এ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে দু’হতে আড়াই বছর সময় লাগবে। আর তাই, তাঁর উপদেষ্টা কমিটিকে সাথে নিয়ে প্রণয়ন করেছেন নতুন কর্মসংস্থানের একটি রুপরেখা যাতে শতকরা ৭৭ ভাগ আবাসন ও খাদ্য সরবরাহে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করা, শতকরা ৬০ ভাগ বিনির্মাণে, বিক্রয় ক্ষেত্রে ৪২ ভাগ সহ পর্যটন ও শিল্পে নতুন বিনিয়োগের দ্বার খুলে দেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন তিনি।
তবে, সব ছাঁপিয়ে আমজনতার দৃষ্টি কেড়েছে ১৬ হতে ২৪ বছর বয়সীদের জন্য করা তাঁর ‘কিক র্স্টাট’ স্কিমটি। ২ বিলিয়ন পাউন্ডের এই প্রণোদনাটি তরুণ গ্রাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা যা বিগত আগস্ট মাস হতে শুরু হয়েছে। বিগত জুলাই মাস হতে অতিরিক্ত ৩০ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করা হয়েছে যাতে অন্তর্ভুক্ত আছে পর্যটন খাতে ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব, মোট ৩,০০,০০০ মানুষকে কর্মপ্রণোদনা দেওয়া, ট্যাঙ বাতিল বেশ কিছু খাতে, কাজের পাশাপাশি বোনাসের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান সহ নানা সৃষ্টিশীল প্রকল্পের এক আশ্চর্য সুন্দর প্রয়োগ।
শক্তিশালী প্রতিবেশী জার্মানী, তাদের সৃষ্ট স্বল্প সময়ে কাজ করার পরিকল্পনাটি বন্ধুপ্রতিম ব্রিটেন ও অনুসরণের অপেক্ষায়। ১২ হতে ২৪ মাস স্থায়ী ‘কুরজারবেত’ নামক সিস্টেমটি চলমান সংকট সমাধানের পথ কিছুটা হলে ও বাতলে দেয় বৈকি! অপর দু’ রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স যা ইতিমধ্যে অনুসরণ করছে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা বিভাগ ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা খাতে নতুন ৬,০০,০০০ কর্মসংস্থান তৈরিতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। ৭.৬ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি প্রণোদনা বাজেট ও অনুমোদনের অপেক্ষায়।
ইউরোপে শীত দোরগোড়ায়, চলতি নভেম্বর মাস হতে কভিড-১৯ সংক্রমণের রেখাটি আবার উর্ধ্বমুখী মৃত্যু হার তুলনামূলক ভাবে কম বিবেচিত রেখেই। ব্রিটেন এখন অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছে, অতি আকাঙ্খিত ‘পিফাইজার’ প্রতিষেধকটি বাজারে। শতকরা ৯০ ভাগ আক্রান্তের সেরে উঠার কার্যকারিতা সময়ের ব্যাপার! অনিশ্চয়তায় মোড়া সময়, খুঁড়িয়ে চলা অর্থনীতি, কোণঠাসা যোগাযোগ ব্যবস্থা, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ডমিনিকের আকস্মিক পদত্যাগ এসব ছাঁপিয়ে বিচক্ষণ রিশি কি পারবেন নবাব সিরাজউদ্দোলার বিশ্বস্ত মোহনলাল, বঙ্গবন্ধুর সোচ্চার কন্ঠস্বর তাজউদ্দিন আহমেদ, কিংবা মনমোহন সিং-এর মত এক অসাধারণ কূটনীতিবিদ বনাম রাজনীতিবিদ অথবা শিক্ষাবিদ যেই নামে ডাকি না কেন বরিস সরকারের সাফল্যের মেয়াদ কে দীর্ঘস্থায়ী করতে? না, আপাত সুস্থ বিশ্ববাসী উপভোগ করবে এক বিশ্বস্ত সেনাপতির একক নৈপুন্যের নিপুণ বিনির্মাণ। ইতিহাস তার অব্যর্থ কলম নিয়ে প্রস্তুত!

[এলবিপিসি, লন্ডন থেকে]

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাস্ক যখন নিত্য সাথী নো মাস্ক, নো টক
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষানীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা