অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আমরা শুধু ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি তা নয়, করের আওতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ২০২০ সালের জুন মাসে সারাদেশে রিটার্ন দাখিল হয়েছিল ২১ লাখ, চার বছর ব্যবধানে ২০২৪ সালে এসে এটি হয়েছে ৩৪ লাখ। ২০২০ সালের জুন মাসে ভ্যাট প্রদানকারী ছিল আড়াই লাখ, সেটি এখন পরিণত হয়েছে ৫ লাখে। তার মানে চার বছরের ব্যবধানে এখন করের আওতা অনেক বেড়েছে। আমরা করের আওতা আরও বাড়াতে কাজ করছি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত প্রাক–বাজেট মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সারা বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চলে আসে। এতে রাজধানীতে মানুষের চাপ বাড়ে। তাদের খাদ্যের যোগান দিতে শাক সবজি থেকে শুরু করে গ্রামীণ অনেক কিছুই ঢাকায় নিয়ে আসতে হয়। শুধু হাসপাতাল নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কারণে দেশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ ঢাকায় চলে আসে। তাই এসব সেবার জন্য দেশের মানুষকে যাতে ঢাকামুখী হতে না হয়, সেজন্য আমরা জেলা পর্যায়ে হাসপাতাল করার ক্ষেত্রে ১০ বছর করমুক্ত রাখার সুবিধা দিয়েছি। শুধু তাই নয়, কৃষিসহ ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমাদের দেশের সার্বিক অর্থনীতি এগিয়ে যায়। আমদানি নির্ভরতা কমে। আমরা উন্নত দেশে পরিণত হলে করের ক্ষেত্রে এখন যে ছাড় পাচ্ছি, সেগুলো আর পাব না।
এনবিআর সদস্য মাসুদ সাদিক বলেন, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। প্রতিবছর আবাদি জমির ১ শতাংশ হারিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে সার, বীজ, কীটনাশকে শূন্য শুল্কহার রেখেছি। কৃষি যন্ত্রপাতিতে শুল্কহার কম রাখা হয়েছে। মেশিনারি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ সুবিধা নিয়ে বড় বড় শিল্প, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের শিল্প গড়ে উঠবে আশা করে এনবিআর। দেশে মোবাইল ফোন, রেফ্রিজারেটর, এসি, মোটরসাইকেল তৈরি ও সংযোজন হচ্ছে। লিফট তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। আশা করি চট্টগ্রামেও লিফট তৈরির কারখানা গড়ে তুলবেন কেউ।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বাজেট প্রস্তাবনায় বলেন, ট্যাক্স টু জিডিপি’র রেশিও বাড়ানো প্রয়োজন, তবে দ্রুত বাড়াতে গিয়ে রাজস্ব নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করার আগে বর্তমান সংকটময় অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা এর চাপ নিতে সক্ষম এবং প্রস্তুত কিনা তা বিবেচনা করতে হবে। তিনি নির্দিষ্ট কর প্রদানকারীর উপর করের বোঝা না বাড়িয়ে বরং করদাতার সংখ্যা কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় তার জন্য একটি যথাযথ পরিকল্পনা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, করনীতির বিভিন্ন ধারার জটিলতার কারণে বেসরকারি কোম্পানির ট্যাক্স ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে মোট কর দায় সবধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রেই ৪০–৫০ শতাংশের ওপরে দাঁড়াচ্ছে। মুদ্রানীতির সংকোচনের ফলে দেশে এমনিতেই বিনিয়োগ ব্যয় বহুল হয়েছে। তাই রাজস্ব নীতির প্রয়োগের চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকলে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হবে এবং বর্তমান বিনিয়োগকারীরাও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। তাই সরকারের অবকাঠামোগত
ডেভেলপমেন্টের বিনিয়োগকে ফলপ্রসূ করতে দেশি–বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিনিয়োগবান্ধব রাজস্ব নীতি এবং পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। চেম্বার সভাপতি আগামী বাজেটে বিবেচনায় নেয়ার জন্য সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বৃদ্ধি করে চার লাখ টাকায় উন্নীত করাসহ ১২ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
চেম্বারের সিনিয়র সহ সভাপতি তরফদার মো. রুহুল আমিন বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য কর ভ্যাট দিতে হবে। আমরা চাই কর ও ভ্যাট আদায় সহজীকরণ করা হোক। নন প্রফিট অর্গানাইজেশন, সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি দেওয়ার আহ্বান জানাই। ব্যবসায়ীরা খুব কষ্টে আছি এইচএস কোড নিয়ে, অনিচ্ছাকৃত ভুলে ২০০ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে। এর ফলে ওই পণ্য ছাড় নিতে পারেন না। বিদেশে টাকা পাঠাতে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনলে অবৈধ চ্যানেলে টাকা যাবে না। রপ্তানির কন্টেনারের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে আরও স্ক্যানার মেশিন বসাতে হবে। অফডকে স্ক্যানার মেশিন বসানো উচিত।
বিএসআরএম ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমেরআলী হোসেন বলেন, রিফান্ড নীতিটা খুব একটা সহজ নয়। এটিকে কিভাবে সহজ করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করতে হবে। এখন সারা বিশ্ব সবুজ শিল্পায়নের উপর জোর দিচ্ছে, আমাদের দেশেও সেটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমরা আমাদের একটি ছোট কারখানার ছাদে সোলার বসাবো। এর জন্য প্যানেল আমদানির ক্ষেত্রে করহার ঠিক আছে। কিন্তু বাকি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ককর অনেক বেশি। এটিকে আলাদা আলাদা না করে যদি পুরো সোলার সিস্টেমকে একটি কাঠামোর মধ্যে এনে সোলার সিস্টেমকে উৎসাহ দিতেন। তাহলে দেশে অনেকে সোলার প্যানেল বসানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতো।
বাংলাদেশ পেপার ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ–সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল বলেন, দেশে উৎপাদিত হয় না এমন উন্নতমানের ওষুধ, মুদ্রণ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ১৫ শতাংশ শুল্ককরের পরিবর্তে প্লাস্টিক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির মতো ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি। এতে মিথ্যা ঘোষণা কমার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ও বেড়ে যাবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে–আমাদের ভ্যাটের মাঠ পর্যায়ের কিছু ইস্যু আছে। সম্প্রতি আমাদের একটি প্রতিষ্ঠানকে মামলা দিয়েছে এক ধারায়, আবার রায় দিয়েছে অন্য ধারায়। আপিল করার পরেও ব্যাংক একাউন্ড ফ্রিজ করা হয়েছে। অপর একটি মামলায় রেকর্ডে আমদানি আছে ২১ কোটি, বিক্রি দেখানো আছে ২৫ কোটি। কিন্তু বিষয়টি গোপন করে ভ্যাট কার্যালয় থেকে আমার নামে এক কোটি টাকা ডিমান্ড ইস্যু করা হয়েছে। সবার স্বার্থে এনবিআরের চেয়ারম্যান মহোদয়কে বিষয়টি দেখার অনুরোধ রইলো।
সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন টিকে গ্রুপের অ্যাডভাইজার মো. জাফর আলম, কনফিডেন্স সিমেন্টের এমডি জহির উদ্দিন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক একেএম আকতার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু, মাহফুজুল হক শাহ, অঞ্জন শেখর দাশ, আকতার পারভেজ, রাকিবুর রহমান টুটুল, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি সালেহ আহমদ, ফেনী চেম্বারের পরিচালক বিলাস চন্দ্র, লুব রেফ বিডির এমডি মোহাম্মদ ইউসুফ, সিমেন্ট ম্যানুফেকচারার প্রতিনিধি আবদুল আউয়াল মোহন, ফ্রেশ ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মাহবুব রানা, মো. শাহজাহান, কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ তাহের, পরিবহন মালিক সমিতির চৌধুরী জাফর আহমদ প্রমুখ।