কয়েক লাখ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্স আটকা

বিআরটিএতে স্মার্ট কার্ড সংকট

হাসান আকবর | শুক্রবার , ২৪ মে, ২০২৪ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

স্মার্ট কার্ডের সংকটে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না হাজার হাজার ড্রাইভার। এতে করে অনেক ড্রাইভারের বিদেশ যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিআরটিএ এক প্রজ্ঞাপন দিয়ে ইলাইসেন্স অনলাইনে দেখানোর সুযোগ দিলেও যারা বিদেশ যাবেন তাদের ক্ষেত্রে এই অনলাইন লাইসেন্স কোনো কাজে আসছে না। সময়মতো স্মার্ট কার্ড না আসায় দেশের কয়েক লাখ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও ড্রাইভারের লাইসেন্স আটকা পড়েছে। বিআরটিএ মাসের পর মাস ডেট বাড়িয়ে ড্রাইভার এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মেয়াদ বাড়ালেও সংকটের সুরাহা হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিরাজমান এই সংকট কবে শেষ হবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। পুরো বিষয়টির পেছনে দেশের ডলার সংকট বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

বিআরটিএর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, একসময় হাতে লেখা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বুক (ব্লু বুক) থাকলেও তা স্মার্ট কার্ডে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে আর হাতে লেখা কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স বা গাড়ির ব্লু বুক নেই। বছরে গড়ে ৮ লাখের মতো স্মার্ট কার্ডের প্রয়োজন হয়। এক বছরেরও বেশি সময় কার্ড সরবরাহ না থাকায় বর্তমানে তা দ্বিগুণের বেশিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর সাথে প্রতিদিনই হাজার হাজার নতুন আবেদন জমা পড়ছে। বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে অন্তত ২৫ লাখ কার্ডের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। সরবরাহকারী ঠিকাদার থেকে গত সাড়ে তিন বছরে ১৬ লাখ কার্ড পেয়েছে বিআরটিএ। এতে করে চাহিদা ও যোগানের বিস্তর ফারাক তৈরি হওয়ায় দেশে কার্ডের সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বিআরটিএর পদস্থ একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্ট কার্ড তৈরির জন্য চুক্তি করে। চুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি ২৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কাজ করার কথা। বছরে আট লাখ করে এই পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৪০ লাখ কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির শর্ত পূরণ করতে পারেনি। সাড়ে তিন বছরে কার্ড দিয়েছে মাত্র ১৬ লাখ। যা বহু আগেই ফুরিয়ে গেছে। ফলে নতুন করে আর কোনো কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের স্মার্ট কার্ড সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, কার্ডের ব্যাপারটি পুরোপুরি বিদেশি কোম্পানিটির উপর ন্যস্ত রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কখনোই আমাদেরকে চুক্তি অনুযায়ী কার্ড দিতে পারেনি। এখন তাদের কাছে কোনো কার্ড নেই। তাই তারা কার্ড আনা এবং ছাপিয়ে সরবরাহ করতে পারছে না। তারা দেশের ডলার সংকটকে পুঁজি করে কার্ড আনতে পারছে না বলে দাবি করলেও পরিস্থিতি আসলে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তারা যখন চুক্তি করেছিল তখন ডলার ছিল ৮৫ টাকা, এখন পৌঁছেছে ১২০ টাকায়। এই অবস্থায় তারা কি করে কার্ড এনে সরবরাহ দেবে সেটি বিআরটিএকে ভাবনায় ফেলেছে।

গতকাল মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের একজন কর্মকর্তার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দোষ আসলে আমাদের নয়। এলসি খোলার মতো ডলার না থাকায় আমরা সময়মতো কার্ড আনতে পারিনি। মাদ্রাজের যে কারখানায় কার্ড তৈরি করা হয় সেখানে লাখ লাখ কার্ড তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে কার্ডও আনা সম্ভব হচ্ছে না। এখন আমরা কিছু কার্ড আনার চেষ্টা করছি। লাখ পাঁচেক কার্ড আপাতত এনে সরবরাহ দেয়ার চেষ্টা করছি। আগামী মাস খানেকের মধ্যে ধাপে ধাপে এসব কার্ড এসে পৌঁছালে আমরা আগে থেকে আটকা পড়া লাইসেন্সগুলো বিআরটিএকে প্রদান করতে সক্ষম হবো। আগামী মাস থেকে কার্ডের সংকট কিছুটা ঘুচবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ড সরবরাহ করতে না পেরে বিআরটিএ একটি সার্কুলার জারি করেছে। যাতে বলা হয়েছে, ড্রাইভাররা বিআরটিএর কিউ আর কোড সম্বলিত ‘ইলাইসেন্স’ স্মার্ট ফোনে দেখিয়ে গাড়ি চালাতে পারবেন। বিদেশ যাওয়ার ভিসা প্রসেসিংসহ যাবতীয় কাজ করতে পারবেন। কিন্তু বিদেশে এই ইলাইসেন্স গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ড্রাইভার। সীতাকুণ্ডের নুরুল আমিন নামের একজন ড্রাইভার বলেন, আমি লাইসেন্সের জন্য বিপদে পড়ে গেছি। মোবাইল ফোনে লাইসেন্স দেখালেও তা গ্রহণ করা হচ্ছে না। অপরদিকে হংকং এ ড্রাইভিং করতে যাওয়া একজন ড্রাইভার জানান, তিনি ড্রাইভারের ভিসা নিয়ে হংকং আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের লাইসেন্সটি নবায়ন করতে দিয়ে আর ফেরত না পাওয়ায় তার সবকিছুই অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। একইভাবে গাড়ির স্মার্ট কার্ড নিয়েও সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় কাজ করা ড্রাইভার নজরুল ইসলাম বলেন, এক বছরেরও বেশি আগে লাইসেন্স নবায়ন করতে দিয়েছি। কিন্তু লাইসেন্স এখনো পাইনি। প্রতিবারই দুই মাস করে সময় বাড়িয়ে দেয়। দুই মাস পর পর বিআরটিএতে গিয়ে ডেট বাড়ানোর ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ডেট বাড়াতে গিয়ে লাইন ধরতে হয়। যা বড় ধরনের হয়রানি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম বিআরটিএ সূত্র জানায়, তাদের কাছে প্রায় ৩০ হাজার লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়ে আছে। যেগুলো সরবরাহ করতে পারছে না। ঢাকা থেকে প্রিন্ট হয়ে আসলে এসব লাইসেন্স ড্রাইভারদের দেয়া ঠিকানায় পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, বহু এমপি মন্ত্রীর রিকুয়েস্টেও লাইসেন্স সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গোপসাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ
পরবর্তী নিবন্ধ৩টি ব্রিজ এখন মরণফাঁদ