ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়লেও কমেছে বাংলাদেশের। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রম অসন্তোষ এবং বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে। দেশের তৈরি পোশাকখাতের সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকায় রপ্তানি কমতে শুরু করায় দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন চীন এবং মেক্সিকোর পণ্যের উপর শুল্ক বাড়ালে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে নন–ট্রেডিশনাল দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। বাজার সমপ্রসারণের বিষয়টি পুরো সেক্টরে দীর্ঘমেয়াদি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় একক ক্রেতা হচ্ছে আমেরিকা। গত বছর আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি তৈরি পোশাক আমদানি করেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ৭ দশমিক দুই শূন্য বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক। কিন্তু আগের বছর যার পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা ৯ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক কিনেছিল। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বাজারে তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যণীয় হলেও গত তিন বছরের এই চিত্র নিশ্চিত করে যে ওই দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর দিকে আমেরিকার ক্রেতারা ঝুঁকে পড়ায় সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি আরো কমতে পারে বলে শংকিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের অনেকেই। তাদের শংকা দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং শ্রম অসন্তোষ এবং অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সুযোগে প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের ক্রেতাদের সরিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অনেক মার্কিন ক্রেতা ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, গত বছর ভারত থেকে আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। গত বছর ভারত প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমেরিকায় রপ্তানি করে। যা আগের বছরের তুলনায় চার দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। গত জুলাই এবং আগস্ট মাসে বেশ কিছু অর্ডার বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়ায় তাদের এই প্রবৃদ্ধি বলেও গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
একইভাবে পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া থেকে আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বেড়েছে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি। তাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে বিদ্যমান পরিস্থিতি থাকলে আমেরিকায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি আরো ধাক্কা খাবে। তবে আশার কথা হচ্ছে নতুন ট্রাম্প প্রশাসন চীন এবং মেঙিকোর উপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে মেঙিকোর তৈরি পোশাকের উপর শূন্য শুল্ক উঠিয়ে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এরফলে আমেরিকায় মেঙিকোর পণ্যের ক্রেতা কমবে।
গত বছর তিনেক ধরে মেঙিকো আমেরিকার প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হচ্ছিল। শত শত চীনা বিনিয়োগকারী শূন্য শুল্কের সুবিধা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চীনে। ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে সেই সুবিধা প্রত্যাহার করে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
অপরদিকে চীনও বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। চীন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে।
চীনা পণ্যের ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে আমেরিকায়। ট্রাম্প প্রশাসন তা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করার চিন্তাভাবনা করছে। যদি সেটা হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের বাজার পুরোপুরি ঘুরে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের উপর যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক রয়েছে।
আমেরিকায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমলেও জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত, কোরিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেঙিকো, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, চিলি, ব্রাজিলসহ অপ্রচলিত (নন–ট্রেডিশনাল) দেশগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। ২০২৪ সালে এসব দেশে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ক্রমাগত বাজার সমপ্রসারণ এই সেক্টরে আশার আলো ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন গার্মেন্টস মালিকেরা। তারা বলেন, যত বেশি বাজার সৃষ্টি হবে ততই আমাদের কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতি বলেন, দেশের তৈরি পোশাকখাতের সুরক্ষায় সরকারকে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। শ্রম অসন্তোষ দমানোর পাশাপাশি পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।