কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স সমূহ আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এ প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত শ্রমিকদের জীবনমান অত্যন্ত নিম্নমানের। শ্রমিকরা অস্থায়ী কাজ, কম মজুরি, এবং কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই দিনাতিপাত করছে। তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
বর্তমান পরিস্থিতি ও সমস্যা: কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স শ্রমিকদের জন্য কোনো স্থায়ী চাকরি বা নিয়মিত বেতন নেই। তারা শুধুমাত্র অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ পেলে আয় করতে পারে। কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেয়া হয় না, ফলে রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে তারা প্রায়শ পুলিশী হয়রানির শিকার হয়।
কমিউনিটি সেন্টার বয়দের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের খাবার সরবরাহ করা। তাদের মজুরি অনুষ্ঠান আয়োজকদের কাছ থেকে নেয়া হলেও, কমিউনিটি সেন্টার মালিকদের পক্ষ থেকে আলাদা কোনও মজুরি দেয়া হয় না। অথচ অনুষ্ঠান শেষে মালিকদের পক্ষ থেকে বিনা মজুরিতে হল পরিষ্কার ও ধোয়া–মোছার কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যা অত্যন্ত অমানবিক।
শ্রমিকদের মাসিক আয় খুবই কম, বিশেষ করে ভরা মৌসুমেও তাদের মাসিক আয় ৫–৬ হাজার টাকার বেশি হয় না। রমজান মাসে কাজের অভাবে তাদের আয় সম্পূর্ণ শূন্য থাকে। ফলে শ্রমিকরা সারা বছর অন্যের উৎসব পালনে ব্যস্ত থাকলেও অর্থের অভাবে তাদের পরিবারের জন্য কোনও উৎসব পালনের সুযোগ পায় না। শুধু তাই নয়, শ্রমিকেরা অনুষ্ঠান শেষে মাঝমধ্যে ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ পেলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা সারা বছরে মিলে এক দিনের জন্যও ভালো খাবার খেতে পারে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
প্রস্তাবিত সমাধান: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স শ্রমিক ইউনিয়নের বার্ষিক সাধারণ সভায় তাদের জীবনমান উন্নয়নে ৭ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। উক্ত ৭ দফা দাবির আলোকে কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে এবং প্রতিষ্ঠান সমূহকে টেকসই করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. মজুরি বৃদ্ধি ও যৌক্তিকীকরণ:
শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি অত্যন্ত কম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুসারে, কমিউনিটি সেন্টার শ্রমিকদের প্রতি ডিউটিতে মজুরি ৪০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮০০ টাকা এবং ডেকোরেটার্স শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১০০০ টাকা করা উচিত। এ বৃদ্ধি শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা দেবে এবং তাদের কাজের প্রতি উদ্দীপনা বৃদ্ধি করবে।
২. বিশেষ দিনগুলিতে অতিরিক্ত মজুরি প্রদান: বিশেষ দিনগুলিতে, যেমন হিন্দুদের লগ্নের দিনে, শ্রমিকদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এ সময়ের জন্য দ্বিগুণ মজুরি প্রদান করা উচিত। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত মজুরি প্রদানের বিধান রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুসারে এটি শ্রমিকদের প্রাপ্য এবং তাদের অতিরিক্ত পরিশ্রমের ন্যায্য প্রতিদান।
৩. জরিমানা নিয়মের বাতিল:
দীর্ঘদিন যাবৎ কমিউনিটি সেন্টার সমূহে ক্রোকারিজ ভাঙার জন্য শ্রমিকদের জরিমানা করা একটি অঘোষিত নিয়ম জারি আছে। শ্রমিকদের মজুরি এমনিতেই খুব কম। তার উপর এ ধরনের মজুরি কর্তন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি মালিকপক্ষের অমানবিক চর্চা যা শ্রমিকদের মনের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এই নিয়মটি অবিলম্বে বাতিল হওয়া বাঞ্চনীয়।
৪. রমজান মাসে সরকারি সহযোগিতা ও দুই ঈদে বোনাস প্রদান:
রমজান মাসে কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে কাজ থাকে না বিধায় তারা পুরো রমজান মাসব্যাপী আয় শূন্য থাকে। তাই রমজান মাসে তাদের আর্থিক সুরাহার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা হিসাবে বিনামূল্যে এক মাস চলার মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা উচিত। এছাড়া, শ্রম আইন অনুসারে মালিকের পক্ষ থেকে দুই ঈদে দুই বোনাস প্রদান করা উচিত।
৫. উৎসবের দিনে কাজ বন্ধ:
শ্রমিকদেরও পরিবারের সাথে উৎসব উদযাপন করার অধিকার রয়েছে। শবেবরাত, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা এবং মে দিবসে কমিউনিটি সেন্টারে কাজ বন্ধ রাখা উচিত। এতে শ্রমিকদেরও পরিবারের সাথে উৎসব উদযাপন করার সুযোগ তৈরি হবে।
৬. কর্মস্থলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবেতন ছুটি ও ক্ষতিপূরণ:
কর্মস্থলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিত। আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, চিকিৎসাকালীন সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে সবেতন ছুটি প্রদান নিশ্চিত করা জরুরি।
৭. অকারণ ছাঁটাই বন্ধ:
শ্রমিকেরা সরাসরি মালিকের বেতনভুক কর্মচারী না হলেও এ সেক্টরেও কোনও কারণ ছাড়াই শ্রমিক ছাঁটাই হয়। এখানে ছাঁটাই বলতে মালিকের তালিকা থেকে শ্রমিকের নাম বাদ দেয়াকে বুঝানো হয়েছে। এধরনের কোনও কারণ ছাড়াই শ্রমিককে মালিকের তালিকা থেকে বাদ দিলে শ্রমিকদের জীবিকায় সরাসরি আঘাত হানে। এটি বন্ধ করতে হবে এবং ছাঁটাইয়ের আগে সঠিক কারণ দর্শানো এবং পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স শ্রমিক ইউনিয়নের ৭ দফা দাবির বাস্তবায়ন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দাবিগুলি বাস্তবায়ন হলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। মালিক ও সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে একটি সমৃদ্ধিশালী শিল্প ও দেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। শ্রমিকদের উন্নতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি অপরিহার্য অংশ, তাই তাদের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা একটি সমৃদ্ধিশালী শিল্প এবং দেশ গড়ে তুলতে পারি। শ্রমিকদের উন্নতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। তাদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা একটি সমৃদ্ধিশালী শিল্প এবং দেশ গড়ে তুলতে পারি। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি উভয়ই লাভবান হবে। মালিকদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে যাতে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত হয় এবং তাদের জীবনে স্থায়ী উন্নয়ন ঘটে।
লেখক: বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক।