
১৯৬০ এর পুরো দশক জুড়ে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইয়ূবের কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যে দেশ কাঁপানো ১৯৬৩ ও ’৬৫ সালের বন্দর শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রধান নেতা, ১৯৭১ সালের মার্চে গণহত্যার উদ্দেশ্যে সোয়াত জাহাজে আনীত অস্ত্র খালাস প্রতিরোধে বন্দর শ্রমিকদের দুঃসাহসী সংগ্রামের মূল নেতা, মুক্তিযুদ্ধের বীর সংগঠক ’৮০’র দশকের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনের চট্টগ্রামের সম্মুখ সারির প্রধান নেতা, আজীবন বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও সিপিবির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, আমৃত্যু পার্টি সদস্য, অকপট বিপ্লবী রাজনীতির মূর্ত প্রতীক, চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী গত ১৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বার্ধক্য জনিত রোগে প্রায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের তথা এদেশের বাম রাজনীতির আজীবন ত্যাগী, সৎ, নির্লোভ, কঠোর নীতিনিষ্ঠ পুরো একটি বিপ্লবী প্রজন্মের বলতে গেলে সর্বশেষ প্রতিনিধির জীবনাবসান হল। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আবদুস সাত্তার, অমর সেন, পূর্ণেন্দু কানুনগো, চৌধুরী হারুন, মওলানা আহমেদুর রহমান আজমী প্রমুখ ঋষিতুল্য ত্যাগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুযোগ্য অনুসারী ও নিবেদিত উত্তরসূরী। বর্তমান সময়ে তাঁদের পরার্থপরতার রাজনীতি, ত্যাগ ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সাধারণের মনে অনেক প্রশ্ন উঠে। এ প্রসঙ্গে একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে তাঁদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক জীবনাচারের অনুপস্থি’তির কারণে সমাজ আজ দুঃসহ অনাচারে, শাসক গোষ্ঠীর দুরাচারে, আর্থ–সামাজিক বৈষম্যের বিষে, ধর্ম ব্যাপারীদের দৌরাত্ম্যে, মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে দেশ আজ ক্রমে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাঁদের চর্চিত দীর্ঘদিনের সৎ রাজনীতি ও গড়ে তোলা অসাম্প্রদায়িক সমাজ মানস ও সংস্কৃতি, সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রভাবের কারণে কিন্তু দেশটা মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ও বাঞ্চিত পথে দেশ চলেনি বলেই স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৪ বছর পর মুক্তি সংগ্রামের সশস্ত্র বিরোধীরাই আজ তাদের না চাওয়া দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বঘোষিত রক্ষকে পরিণত হয়েছে। আহসান উল্লাহ চৌধুরীরা যদি ব্যর্থ ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান তা হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রকৃত শক্তি, ’৭১ এর পুরো মুক্তিযুদ্ধই আজ ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হয়।
স্বাধীনতার পরে তাঁরা আরো প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী হয়ে দেশের হাল ধরতে পারেননি তা শুধু তাঁদের দলীয় ব্যর্থতার কারণেই নয়, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের অনুদার ও আত্মম্ভরী ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব নির্বিচারে সব কিছু নিজের মনে করে দলের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী আর কারো বিশেষ করে ন্যাপ–সিপিবি’র উত্থান ও প্রগতিশীল শক্তি সমাবেশ চায়নি শুধু নয়, পদে পদে তাদের বাধা দিয়েছে। অথচ বাস্তব কারণে ন্যাপ–সিপিবি’র পক্ষে সেদিন জাসদের মত সরকার উৎখাতের শ্লোগান তোলা সম্ভব ছিলনা। সেই সুযোগে বিকল্পের অভাবে তখন থেকেই পরাজিত শক্তি নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে কখনো জাসদের, কখনো উগ্র বামের এবং প্রধানত শাসক দলেরই ছায়ায়, নেতৃত্বে ও প্রশ্রয়ের অনৈতিক পথে। এ কারণেই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ন্যাপ–সিপিবির ২০–২৫ টি আসনে নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে প্রগতিশীল বিকল্প গড়ে উঠার সম্ভাবনা ও পরিবেশ নষ্ট করে দেয়া হল। দলের এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করতে পারেননি বলে নীতিনিষ্ঠ প্রাজ্ঞ নেতা তাজউদ্দিনকে সরকার ও দল থেকে বের হয়ে যেতে হল। রাজনীতিতে সেদিন এ ভাবে যে দুর্বৃত্তায়নের সূচনা হল শেষ পর্যন্ত মার্কিন মদদে ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসনের অধীনে এবং বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশে সামরিক শাসকের প্রবর্তিত লুটেরা উদার বাদী অর্থনীতির নামে এক দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির দেশে পরিনত হল। এভাবে স্বৈরশাসনের ভবিষ্যৎ পথ সেদিনই চালু করা হয়। রাজনীতির সাথে ধর্মের রসায়নে জেনারেল জিয়া রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করে দেয়ার যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন আরেক সামরিক শাসক এরশাদ এসে সেই ধারাকে সাধ্যমত শক্তিশালী করে তুললেন এবং অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম চালু করে অপরাপর ধর্মের অনুসারীদের স্বাধীন দেশে কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করলেন। দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রহীন পরিবেশে ক্রমে গড়ে উঠে এক সাম্প্রদায়িক সমাজ মানস। ব্যাংক খাত ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে লুটপাট ও টাকা পাচারের প্রক্রিয়া শুরু করল এরশাদ সরকার। ধর্মের লেবাসে দলগতভাবে শিক্ষা ব্যবসা, স্বাস্থ্য ব্যবসা, ব্যাংক ব্যবসার মাধ্যমে একটি দল দলগত ভাবে অধর্মের পথে দেশের সবচেয়ে অর্থশালী দলে পরিণত হয়ে রাজনীতি ও ব্যবসাকে একাকার করে রাজনীতিতে নানা আর্থিক প্রণোদনা ও বিপননের মাধ্যমে দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠল।
কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী তখন এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই পুরো সময়ে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন তথা স্কপ গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা রেখে, ১৫ দলের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদের পতন নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক ভূমিকা পালন করেন। এই সময় তিনি চট্টগ্রামের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতায় পরিণত হন। দেশ পরিচালনার জন্য তৈরি হলো তিন জোটের রূপরেখা। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিজয়ী দল বিএনপি ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের রূপরেখা অগ্রাহ্য করে সামরিক শাসকদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ও অর্থনীতির পথে দেশ পরিচালনা করতে থাকে। আওয়ামী লীগ ’৮০র দশক থেকেই সেই লুটেরা রাজনৈতিক অর্থনীতি অনুসরণ করে, ধর্মান্ধ মৌলবাদের সাথে আপোষের পথকেই ক্ষমতা দখল ও চিরস্থায়ী করার দুঃস্বপ্নে মেতে উঠে। ১৯৬০ ও ’৭০ এর দশকের পেটি বুর্জোয়া আওয়ামী লীগ বস্তুত ৯০ এর দশকের পরে লুটেরা ব্যবসায়ীদের দলে পরিনত হয়। ’৯০ পরবর্তী সময়ে শাসক গোষ্ঠীর একটি দ্বিদলীয় বৃত্ত তৈরি হয়। ঠিক এসময়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী প্রগতির আন্দোলন মারাত্মক বিভ্রান্তি ও ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়। এতে সিপিবি নানা ভাবে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আহসানউল্লাহ চৌধুরী তাতে মুষড়ে না পড়ে পার্টিতে সুবিধাবাদ ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে ’৬০ এর দশকের মত লড়াই করে পার্টিকে পুনর্গঠন করেন। কিন্তু তার পুনর্গঠিত পার্টিতে সিপিবি’র দীর্ঘদিনের অনুসৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থলে ভিন্ন সংস্কৃতির প্রাধান্য দেখে পার্টি প্রেসিডিয়াম থেকে পদত্যাগ করে দূরে সরে যান। তবে আমৃত্যু তিনি পার্টির সদস্য ছিলেন এবং বিপ্লবী প্রত্যয় ধারণ করে চলেছেন।
’২৪ এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থান দ্বিদলীয় রাজনীতির অশুভ বৃত্ত ভেঙেছে বটে কিন্তু সাধারণ ছাত্র জনতার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে আরো দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলতার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বৃত্ত তৈরি হয়েছে। সেই শক্তি প্রকৃত ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর ক্রমাগত হামলা চালাচ্ছে ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে। সংকট ফলে গভীরতর হচ্ছে যা ইতোমধ্যে স্পষ্ট। এরি ফাঁকে এই অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বঙ্গোপসাগর, মায়ানমার ঘিরে যেমন একদিকে চলছে সশস্ত্র মহড়া তেমনি যা কোনদিন হয়নি, সরকার প্রধানের নানা নাটকীয় বয়ানের আড়ালে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের ৩টি বন্দর একসাথে মার্কিন প্রভাবিত বিদেশী কোম্পানীর কাছে ছেড়ে দেয়ার চুক্তি চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অস্থায়ী সরকার। এমতাবস্থায় বেঁেচ থাকলে নিশ্চয় আহসান ভাই আবারো তাঁর প্রিয় কর্মস্থল বন্দর চত্বরে গিয়ে অতীতের মত গর্জে উঠতেন। ক্ষমতা প্রত্যাশী দুই দলের এতে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় যথাক্রমে ডান ও অতি ডান এই দুই প্রধান দলের কোনটি যুক্তরাষ্ট্রের আপাত কাছের তা এখনো অস্পষ্ট। কার্যক্রম নিষিদ্ধ এক সময়ের অন্যতম বৃহৎ দল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত নিয়েও ইদানিং মার্কিন পরিকল্পনার নানা আলামত চোখে পড়ছে। নির্বাচন প্রলম্বিত করার চক্রান্ত চলছে নানা দাবীর আড়ালে। বাম দলগুলো সহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। ৩০ লক্ষ শহীদের নজিরবিহীন গণহত্যায় মুক্ত আমাদের প্রিয় স্বদেশ এখন একটি ‘হট বেড অব ইন্টারন্যাশনাল ক্লিক’। মনে পড়ে জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কথা ‘অদূ্ভত আঁধার এক নেমেছে পৃথিবীতে আজ/ …….. যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই, প্রীতি নেই, মানুষের জন্য করুণার আলোড়ন নেই/ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া / পৃথিবী আজ অচল’
কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী ও তাঁর পূর্ব প্রজন্মের সর্বত্যাগী বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক সমতা, বৈষম্যমুক্ত সমাজ তথা সমাজতন্ত্র। জাগতিক জীবনের দুঃসহ নিপীড়ন ও দারিদ্র্য থেকে ধর্ম–বর্ণ সহ সব মানুষের মুক্তির মানবিক লক্ষ্যই ছিল এ দেশের সব গণআন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা। এই গণআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে প্রধান যে বাধা আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থা, এবং বিশ্ব পুঁজিবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এই সত্য আজ যেমন সবাই বুঝতে পারছে তেমনি এই অমোঘ সত্য তাঁরা আমৃত্যু শুধু উচ্চারণ করে যাননি বরং এই ব্যবস্থা বদলের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন। এতে সাফল্য আসেনি বলেই দেশ আজ এক অভাবনীয় সংকটে নিমজ্জিত। এজন্যই কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরীর জীবন ও রাজনীতি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।











