কবি শঙ্খ ঘোষ আর নেই

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ২২ এপ্রিল, ২০২১ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের পর বাংলা কবিতার তরী যারা বেয়ে নিয়েছেন আগামীর গন্তব্যের পথে, তাদের অগ্রপথিক কবি শঙ্খ ঘোষকে কেড়ে নিল করোনাভাইরাস। গত ১৪ এপ্রিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ৮৯ বছর বয়সী এই কবি। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাড়িতেই তিনি পরলোকগমন করেন। সেই সঙ্গে বাংলা কবিতায় একটি যুগের অবসান ঘটে। তাঁর জীবনাবসানে সর্বত্র নেমে আসে শোকের ছায়া।
শঙ্খ ঘোষের পারিবারিক নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে জন্ম। আর বাংলা কাব্য সাহিত্যে তার আর্বিভাব বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গির খোঁজে চল্লিশের দশকের যে তরুণ কবিরা কৃত্তিবাস বা শতভিষা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুন এক রোমান্টিক জগতের সৃষ্টি করেছিলেন, শঙ্খ ঘোষ তাদের একজন। শক্তি, সুনীল, শঙ্খ, উৎপল, বিনয় -এই পাঁচ কবিকে বলা হত জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডব।
‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/ শব্দহীন হও/ শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর/ লেখো আয়ু লেখো আয়ু।’ শঙ্খ ঘোষ ছিলেন একাধারে কবি, গদ্যশিল্পী, রবীন্দ্র গবেষক, সাহিত্য সমালোচক এবং শিক্ষক। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন তিনি। সেই রোমান্টিক শঙ্খের কাব্যভাষা প্রেমের লহরি বাজিয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের বাস্তবতায় ভিন্ন এক ব্যঞ্জনায়। আবার তা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে প্রায়ই। জরুরি অবস্থার মধ্যে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শঙ্খের প্রতিবাদ এসেছে ছন্দের ছদ্ম আবরণে। আবার কখনও তা অনেক সরাসরি- তীব্র শ্লেষের তীর হয়ে বিঁধেছে। শাসকের মুখোশ খুলতে সবিনয় নিবেদন কবিতায় তিনি লিখেছেন : ‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি/ অক্ষরে অক্ষরে/ যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে।’ আবার কুচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলির প্রতিবাদে শঙ্খের কলম লিখেছে : ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে/ একটু আগুন দে।/ হাতের শিরায় শিখার মতন/ মরার আনন্দে।’
হাল আমলে নাগরিকত্ব আইনেরও প্রতিবাদ এসেছে তার ‘মাটি’ কবিতায়। শঙ্খ ঘোষের বাবা মণীন্দ্রকুমার ঘোষের পৈতৃক ভিটা ছিল বরিশালের বানারীপাড়ায়। তবে বাবার কর্মস্থলের সূত্রে তার কৈশোরের একটি অংশ পাবনায় কেটেছে। সেখানে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিক দিয়ে চলে যান কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন শঙ্খ। পরে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন। কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করার পর ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দেন শঙ্খ ঘোষ। পরে ফিরে এসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতীতে তিনি অধ্যাপনা করেন।
শঙ্খ ঘোষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিনগুলি রাতগুলি’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। এরপর বাংলা কবিতার পাঠকদের তিনি দিয়েছেন ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’, ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’, ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’, ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’, ‘শবের উপরে শামিয়ানা’, ‘ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার’, ‘মাটিখোঁড়া পুরোনো করোটি’, ‘বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে’, ‘শুনি নীরব চিৎকার’, ‘এও এক ব্যাথা উপশম’সহ তিন ডজন কাব্যগ্রন্থ। তাঁর চার ডজন গদ্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘ছন্দের বারান্দা’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘শব্দ আর সত্য’, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, ‘কবিতার মুহূর্ত’, ‘কবির অভিপ্রায়’, ‘সময়ের জলছবি’, ‘লেখা যখন হয় না’র মত বই। শঙ্খ ঘোষ ছোটদের জন্যও বিশটির বেশি বই লিখেছেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান শঙ্খ ঘোষ। কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত ‘রক্তকল্যাণ’ নাটকটির জন্য ১৯৯৯ সালে আবারও তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়া রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়া এ সাহিত্যিককে ২০১১ সালে পদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত করে ভারত সরকার। আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, গতকাল বুধবার বিকেলে নিমতলা মহাশ্মশানে কবি শঙ্খ ঘোষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅন্য দেশ থেকেও টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধবেড়ানোর কথা বলে জিম্মি টাকা না পেয়ে হত্যা