বলা হয়ে থাকে, কবিরা সৃজন–ঈশ্বর। তারা সারাক্ষণ ধ্যান–জ্ঞানে যা নির্মাণ করেন, তা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কবি খুরশীদ আনোয়ার তেমনই এক কবি, যিনি কৃষি শ্রমিকের মতোই লিখনের জমিতে সযত্নে বপন করেন কবিতার পোক্ত বীজ। তাঁর মনের সঙ্গে মননের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা কাব্যভুবন বিষয়বিন্যাস,শব্দচয়ন,নির্মাণশৈলী ও চিত্রকল্পে আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। তাঁর কবিতার অনিবার্য ও আকর্ষণীয় দিক হলো, তিনি কবিতায় সমসাময়িকদের মতো বিবরণবহুল শিথিল পঙ্ক্তিমালায় নিজেকে সমর্পন করেন নি ; তবে সংহত ও সংক্ষিপ্ত কাব্যিক উচ্চারণে তিনি সমুন্নত । শব্দ, চরণ ও স্তবক চয়নে তিনি প্রথাছুট, ব্যতিক্রমী; তবে তা মাটিলগ্ন, প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশ ঘনিষ্ঠ।
তাঁর কবিআত্মার দীর্ঘ বোধের সরব উচ্চারণে প্রকৃতি, অনাবাদি জমি, নদী, আকাশ, চাঁদ বেশ সরব, যেখানে কবিতা কথা বলে তূর্যবাদকের মতো। তাঁর চারপাশের প্রকৃতিই যেন তাঁকে কবিতার পথ বাৎলে দেয়। ‘পথ’ কবিতায় কবি লিখেন–
“একজন কৃষক যখন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর/ জন্যে অনাবাদি জমি পার হয় / তখন সে পদচিহ্ন হয়ে ওঠে মানুষের পথ”
কিন্তু তিনি এ চিরাচরিত পথের বাইরে হাঁটতে চান, যে পথ কুয়াশাচ্ছন্ন নদীর মতো।
“হায়, আমার এ–মুহূর্তে একটি কুয়াশাচ্ছন্ন/ নদীর কথা মনে পড়ছে/ বন্দরে ভিড়বার আগে যাকে আমি /হাজার হাজার জনম দেখতে পেয়েছি ! ” (পথ, প্রেম শহরের পথে)
এভাবে তাঁর কবিতায় দূরাগত এক কবির কাব্যবোধের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যিনি আবহমানতার অস্পষ্ট জঠর থেকে তুলে আনতে চান এক অনিন্দ্য সুন্দর সকালের কুয়াশা নদী–
“কাল এসো /তুমি এলে তোমাকে একটি অনিন্দ্য সুন্দর সকালের /কুয়াশা নদী উপহার দেবো ;যে নদী হাজার রজনীর বাহুলগ্ন থেকে /নিজেকে ছাড়িয়ে একা তোমারই অপেক্ষায়।”
(আলোর ভাস্কর্য, প্রেম শহরের পথে)
এ কুয়াশা নদীর গহীনে ওৎ পেতে আছে তাঁর কবিত্ব শক্তি, যার ব্যাপারে তিনি প্রচণ্ড আস্থাশীল। তিনি নিজেই বলেন–
“আমার ভেতর একটি বিশাল আকাশ। /অপেক্ষায় আছি, /
একদিন হৃদয় আলোকিত করে একটি প্রার্থিত চাঁদ /উঠবেই উঠবে অন্তপুরে ;/যে বাসগৃহে আমার অখণ্ডতা ঘুমিয়ে রয়েছে।”
(ত্রিশ নং কবিতা, হালকা কবিতা)
তিনি আসলে সত্তর দশকের একজন সফল কবি, মুগ্ধতা যার কবিতার পরতে–পরতে আঁচড়ে পড়ে। যার কবিতার সুঘ্রাণ পাঠক মনে দুলুনি দেয়। লক্ষ করুন নীচের কবিতা–
“তোমার স্পর্শের মধ্যে কবিতার ভ্রুণ ছিলো /কিছুই বুঝিনি /সমুদ্র সৈকত ছিলো ধবধবে চাঁদের পোশাকে /বালিয়াড়ি আড়ি আড়ি খেলছিলো /জল আর নিজের ভেতর। /এনসব জল তীর সহবাস থেকে খসে আসা /সফেদ সমুদ্রফেনা, স্বপ্ন, রঙ, জলপাই শাখা ; /ওলট–পালট খেয়ে বালুচর পায়ে পায়ে /
উসখুস সর্বভূমি হও।”
(সিসফায়ার নেই, অগ্রন্থিত কবিতা)
তাঁর ‘হালকা কবিতা’ গ্রন্থের ৭ নং কবিতা–
“শুনেছি দেওয়ালেরও কান থাকে /তাহলে বাথরুমের চোখ থাকতে /অসুবিধে কোথায় ? /”
পাঠক লক্ষ করুন, সে চোখ দৃষ্টির পিপাসা মেটালো কিভাবে–
“এবার উঠে এলো ঘৃত কুমারীর /সুবাসিত সাবান /শুধু ছুঁয়ে গেলো না, চেটেপুটে খেলো /আদ্যন্ত শরীর,/শরীরের কোমল লোমকূপ /মানবীয় পাহাড়ের চড়াই–উৎরাই ”/
কিন্তু এসব দেখেও বাথরুম নিস্তেজ! তাঁর কথায়–
“ভাগ্যিস, বাথরুম, জল আর সাবানের/চোখ থাকলেও, থাকে না মন।”
কী চমৎকার তাঁর কবিতার বুনন। একইভাবে প্রকৃতি তাঁর কবিতায় সমপস্থিত অনন্য দোত্যনায়–
“বিকেলটা ভাঁজ হয়ে ঢুুকে পড়েছে সন্ধ্যার ভেতর।/গোধূলি যৌবনের লাল কামরঙ /ছিটোয় অঝোরে /প্রকৃতিনারীর দেহের ওপর।”
(বৃক্ষ বিলাপ, প্রেম শহরের পথে)
খুরশিদ আনোয়ারের কবিতা জীবনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা অনুভবের এক ধরনের ভাবব্যঞ্জনা, যা স্মৃতিকে তাড়া করে। গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এ–কবি বসবাসের সুবাদে শহুরে জীবনে অভ্যস্থ হলেও গ্রামের প্রতি তাঁর অনুরাগ আজও বহমান। শৈশবের ঝিঁঝি ডাকা গ্রাম এখনও তাঁর স্মৃতিতে অম্লান–
“মাথার ফাঁকায় বিশাল একটা গ্রাম,/শহর–জন্ম বিষাদ লাগছে তাই /ঝিঁঝি রাগে গাইছে ভেতর–খোকা”
(ঝিঁ ঝিঁ পোকার গল্প, প্রেম শহরের পথে)
শুধু তাই নয়, শহুরে ইট–কংক্রিটের বিষাদ জীবনের বিপরীতে সে স্মৃতি এখনো তাকে ব্যঙ্গ করে হুল ফুটায়–
“দু’বসন্ত উল্টে আছি চোখের ভিতর ! /যেমন করে / ঘরে ঘরে /উল্টে থাকে অবহেলায় আরশোলাটি; /একটু দূরে নদীর তীরে /দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ /উল্টে থাকে জলের ছায়ে, /ঠিক সে রকম পায়ে পায়ে /হোঁচট খেয়ে উল্টে আছি দু’বসন্ত স্মৃতির ভিতর।”
(দু’বসন্ত উল্টে আছি, প্রেম শহরের পথে)
স্মৃতিময় সে গ্রাম বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার মানুষ, ভেঙে যাচ্ছে একান্নবর্তী সংসার–
“অনন্ত সময় তার তীক্ষ্ম খুরে /পথের ধুলো নিয়ে উড়াচ্ছে বাতাসে সব স্মৃতি /অমলেশ ক্ষয়ে যাচ্ছে, তার চোখে অপূর্ব সংসার /ভাঙছে ইচ্ছের ভোর কেবল ভাঙছে।”
(লজ্জাবতীর গল্প, এক পুরুষের রাধাচিন্তা)।
সে–ভাঙনে কবির ভেতর আজ হাহাকার। তার নিজের কাছে তাকে মনে হয়–
“আগুন যেভাবে ধুঁয়ো আমিও আমাদের /ছেলেবেলার দু‘একটি ছোট নদী, খাল আজকাল /খাঁ খাঁ খোলা প্রান্তর, বিরান জন্মভূমি। ”
(রূপান্তরী হলে যা হয়, এক পুরুষের রাধাচিন্তা) ।
কবি খুরশীদ আনোয়ার প্রেমের কবিতাও লিখেছেন। তাঁর কোনো কোনো প্রেমের কবিতায় শরীরস্পর্শী আবেগের ছোঁয়া লক্ষ করা গেলেও পরিশেষে তাঁর প্রেম নিখাঁদ। প্রেমিকার প্রতি তার আকুতি–
“গোলাপের মতো হও সুন্দর /বেলির মতো শাদা, /এক নদী আমি হয়েছি কৃষ্ণ /তুমি এক ফোটা হও রাধা।”
(সুষম প্রার্থনা, এক পুরুষের রাধাচিন্তা)।
তারপরও প্রেমিকা তাকে ত্যাগ করে গৃহী হওয়ায় প্রেমিক কবির স্বগোতক্তি–
“আমাকে সন্ন্যাস দিয়ে, তুমি কেন গৃহী হয়ে গেলে? /সন্ন্যাসী উদাস হয় যেমন আকাশ। /
(পক্ষপাত, এক পুরুষের রাধাচিন্তা)।
কিন্তু সে প্রেমিকা যদি নিজেকে বিপন্ন মনে করে, তখন প্রেমিক কবি তাকে আশ্রয় দিতেও কুণ্ঠিত নন–
“বিপন্ন ক্রান্তিকালে আমি এক দয়ার্দ্র কবি /বুকের বোতাম খুলে দিচ্ছি আজ তোমাকে আশ্রয় /সমস্ত অনীহা ভুলে এই বেলা ঢুকে পড় বুকের ভেতর /সাজাও বাগান এক নিরাপদ সৌন্দর্য–অধীন।”
(তুমি আজ ডেফনি লরেলবৃক্ষ প্রিয়তমা,এক পুরুষের রাধাচিন্তা) ।
তবে তিনি এও মনে করেন, ভালোবাসা পিচ্ছিল অনুরাধার মতো অধরা। ভালোবাসার মোহে পুরুষ–নারী উভয়েই একে অন্যে একাত্ম হওয়া অনেকটা মৌমাছির প্রতিরূপ, মধুটাই এখানে মুখ্য। যদিও ভালোবাসা এক ধরনের ভয়ানক অসুখ। তাঁর কবিতা–
“আমাকে এখন ভীষণ পাচ্ছে অসুখে /ভালোবেসে এক অন্যপূর্বা পশুকে। /কার সাথে থেকে জলেমেশে হল কাদা /বড়ো পিচ্ছিল রাঙা সর্পিল অনুরাধা।”
(দুজনই মৌমাছি, অগ্রন্থিত কবিতা)
ভালোবাসা নিয়ে যাপিত জীবনের গহীনে যে অম্ল–মধুর বাস্তবতার অনিবার্য বোধ, তার নিবিড় দৃশ্যপট এভাবে তার কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠে।
কবি নিজে এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে যে উপলব্ধি চয়ন করেন–
“আমার বাবার হাত, জোছনা যুদ্ধের জলে /ঢেউ তুলেছিল, /কেন তুলেছিল ? /যে ঢেউ দেখে না কেউ অতীত পললে।”
(পুরস্কার: রজত জয়ন্তীকালে, দেশে নই দেশান্তরেও নই)
অথচ এত তাড়াতাড়ি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। সে গৌরবময় কারণ তাঁর কথায়–
‘রক্ত’ শব্দটি তোমার আর আমার খুবই চেনা /‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দ কথাটি তোমার আর আমার কম চেনা নয় !
(যুগল ইচ্ছে, প্রেম শহরের পথে)
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা এদেশ। সে সময়ের সে বীভৎসতায় দেবতা শিবেরও ধ্যানভঙ্গ হয়–
“পৃথিবীর তিন ভাগ লোক এসে দেখে /লাশের ভেতর জেগে–ওঠা এক দ্বীপ, /দারুচিনি মায়া পলাশের রঙ মেখে /ধ্যান ভেঙে আসে তৃতীয় চোখের শিব।”
– (লাশ, দেশে নই দেশান্তরেও নই)।
এতকিছুর পরও মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত সাম্য, মুক্তি আজও দূর অস্ত। এজন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর হৃদয়ের রক্তক্ষরণও কম নয়–
“আজ আমিও মানুষের প্রার্থিত মুক্তির জন্যে /বুলেটবিহীন অন্তঃক্ষরণে রক্তাক্ত হয়েছি।”
কিন্তু এ পথ থেকে মুক্তির চাবি তাঁর তো নেই, যা তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার ছিল, যিনি মুক্তির মন্দির সোপান তলে নিজেকে আত্মাহুতি দিয়ে তা আমাদের দিয়ে গেছেন। তাঁর কথায়–
“হাওয়াতে তালা ঝুলিয়ে /যারা বাইরে গিয়েছিল /সবাই হারিয়েছে চাবি /আমার প্রয়াত বাবা /চাবিঅলা ছিলেন বলে /তারা আমাকে খুঁজছে /কারণ, তারা ভাবছে /উত্তরাধিকার সূত্রে হয়তোবা /আমিও একজন দক্ষ চাবিঅলা। /আমাকে কোথায় পাবে ? /আমিতো অবরুদ্ধ /লখিন্দরের নিশ্ছিদ্র দুঃসহ ঘরে।”
(কবিতা নং ‘পনের’, হালকা কবিতা)।
আবার তিনিই বলছেন–
“তোমাকে কফিনে রাখবার পর /অপেক্ষমান স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী দেশের /স্বাধীনতা আমি /আমি, আমি আর শুধু আমি।”
এখানে তিনি চমৎকার দৃঢ়তায় মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন ‘অপেক্ষমান স্বাধীনতাকাঙক্ষী’ হয়ে। এখানেই তাঁর কবিতার সার্থকতা।
কবি যখন দেখেন, দেশটা স্বাধীন করা হলেও এদেশের মানুষের মুক্তি মেলেনি। স্বৈরাচারী অপশাসনে বিপর্যস্ত এদেশের মানুষ। তাদের দুঃসময়ে মানুষের দুঃখে উদ্বেলিত কবির উৎকণ্ঠা–
“সময় যে বেশ /দুধার তীক্ষ্ম /সমুদ্র খুব রুক্ষ /চুলের ওপর হাঁটছে মানুষ /পা জোড়া কী সূক্ষ্ম /তোমার তাই নাম রাখলাম /দুঃখ বোধের দুঃখ। ”
(সময়, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক হাওয়া)
এর থেকে পরিত্রান প্রয়োজন। কিন্তু স্বৈরাচারী নিষ্পেশনে মানুষ তো হতোদ্যম। দুঃশাসনের অন্ধকারে ঢাকা দিবালোক। নতুন সম্ভাবনার সুযোগ কোথায়?
“রাতের উদরে দিন /হাঁপাচ্ছে, সঙ্গমের ক্ষমতা কোথায় ? ”
(ফাটা ঢেউ, তরবারি সমুদ্র, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক হাওয়া)
সবকিছু দেখে–শুনে নিজের চুপ করে থাকাও মেনে নিতে কবি নারাজ। কবিসত্তার প্রতি তার অনুযোগ–
“সবকিছু দেখে শুনে চুপ করে আছো /কেন, কেন, কেন? /তুমি কি জন্মান্ধ ? শুনেছি তোমার নাকি /শরীরের চারদিকে চোখ /হাজার লোকেরা বলে তোমার দেখার /ক্ষমতা অসীম।”
(অন্যরকম বসে থাকা, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক হাওয়া)
কবি খুরশীদ আনোয়ারের কবিতার সবচেয়ে বড় দিক হলো, তাঁর কবিতার স্বদেশ সংলগ্নতা। সমকাল আহরিত জীবন অভিজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত তাঁর কবিতা শব্দের কারুকাজে অনবদ্য। তাঁর কাব্যভাষা উন্নত, প্রবুদ্ধ ও বিকশিত চৈতন্যের ভাষা। প্রচণ্ড দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় তিনি উপনীত হন আপন অস্তিত্বের মর্মমূলে। তবে তাঁর কবিতা একরৈখিক নয়– উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প প্রভৃতিও তাঁর কবিতার সহযাত্রী। দেশ, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতিকে উচ্চকিত করার ক্ষেত্রে তাঁর নিরীক্ষাধর্মী কবিতাগুলো বহুবর্ণিল আলোয় উজ্জ্বল,উদ্ভাসিত।