কবি কামাল চৌধুরীর প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন চাই : ‘বাংলাদেশের ঠিকানা হোক বাংলা একাডেমি’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের বরেণ্য কবি, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল চৌধুরী বাংলা একাডেমির কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলা একাডেমির বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেশের বিভিন্ন জেলায় আয়োজন করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেছেন, তবে এজন্য বিভিন্ন জায়গায় বাংলা একাডেমির শাখা করার প্রয়োজন নেই। একাডেমি থেকে যে সেমিনার বা অনুষ্ঠান হয়, সেগুলো একাডেমির মিলনায়তনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জায়গায় করা যেতে পারে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য বাংলা একাডেমির অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এর জন্য কার্যক্রমকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় কবি কামাল চৌধুরী এ কথা বলেন। এ সময় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ একাডেমির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলা একাডেমিকে বুদ্ধিবৃত্তিক মননের প্রতীক উল্লেখ করে কামাল চৌধুরী বলেন, সাহিত্যকে গণমুখী করার জন্য বাংলা একাডেমিকে তাগিদ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অনুবাদ ও গবেষণা বাড়ানোর জন্য নানামুখী পরিকল্পনা করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ বহির্বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া এবং বহির্বিশ্বের অনুবাদ বাংলায় করতে হবে। সম্পাদনা, বইকে নান্দনিক করার প্রশিক্ষণ, সারাদেশে যেন একাডেমির কাজ দৃশ্যমান হয় তার উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করেছি।’

এখানে উল্লেখ করতে পারি, ২০২২ সালে একুশে বইমেলা উদ্বোধনের সময় জেলাউপজেলা পর্যায়ে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক জেলায় বা মহকুমায় অতীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সাহিত্যচর্চা হতো, সাহিত্য সম্মেলন হতো, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। এই চর্চাটা অনেকটা কমে গেছে। এটাকে আবার একটু চালু করা দরকার।’ প্রত্যেক জেলার পাশাপাশি এখন উপজেলা পর্যায়েও শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও আপনারা যদি একটু উদ্যোগ নেন তাহলে আপনারা দেখবেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মেধাবী কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী আমরা পাবো। এতে তাঁদের জ্ঞান ও মেধা বিকাশের যেমন সুযোগ আসবে তেমনি মানুষের হৃদয়ের খোরাকটাও তো দরকার। খাদ্য নিরাপত্তা আমরা করে দিয়েছি, এখন হৃদয়ের খোরাকটা জোগাতে হবে। আর তা সংস্কৃতিসেবীদের মধ্য থেকেই আসে। সাংস্কৃতিক জগৎ বা আমাদের শিল্প সাহিত্য জগৎ বা এই ধরনের মেলা যদি হয় বা অনুষ্ঠানগুলো যদি হয় তাহলে কিন্তু আমাদের যারা যুবসমাজ রয়েছে তারাও ভিন্ন পথে যাবে না। তারা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রতিও আন্তরিক থাকবে।’

কবি কামাল চৌধুরী যথার্থ অর্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশা করেন বাংলা একাডেমির কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।

অবশ্য বাংলা একাডেমি ইতোমধ্যে জেলাউপজেলা পর্যায়ে সাহিত্যমেলা আয়োজন করে এ মহাযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে। ‘জাতিসত্তার কবি’ হিসেবে খ্যাত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা উপজেলা সাহিত্যমেলা বিষয়ে নিজেই বলেছিলেন, ‘জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে জেলা সাহিত্যমেলার পর এখন চলছে উপজেলা স্তরে সাহিত্যমেলা। তারপর কি গ্রামসাহিত্যমেলা? অবশ্যই। কেননা সাহিত্যের শুরু তৃণমূল থেকে; ব্যক্তিপ্রতিভা ও তার সৃষ্টিশীলতার মূল উৎস থেকে। বাঙালির সৃষ্টিশীলতাকে সর্বব্যাপী করতে হলে প্রান্ত ও কেন্দ্রের বন্ধন অচ্ছেদ্য করার কোনো বিকল্প নেই।’ সাহিত্যমেলার মতো আয়োজন পাঠক ও লেখকদের মাঝে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নতুন প্রজন্মের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির জন্য এ ধরনের আয়োজন ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলা একাডেমির অন্যতম প্রধান কাজ হলো ভাষার উৎকর্ষতা সাধন ও রক্ষা করা। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, ‘এখন আমাদের বাংলাভাষার যে দুরবস্থা তা আমাদের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অফিস আদালতের ভাষা ব্যবহারের দিকে তাকালে সহজেই বোধগম্য। ভাষা পর্যবেক্ষণ ও উৎকর্ষ রক্ষায় বাংলা একাডেমি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা ভাষা পর্যবেক্ষণ পরিষদ করতে পারে। একই সঙ্গে অভিধানের জন্যে স্থায়ী একটা বোর্ড বা কেন্দ্র থাকা দরকার। বিশেষ করে নতুন শব্দ বা ভুক্তির বিষয়ে সর্ব সামপ্রতিক দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। এখন নতুন একটা বিদেশি শব্দের নিজস্ব ভাষায় তার শব্দ অনুসন্ধান না করে আমরা বিদেশি শব্দটাই চালিয়ে দিচ্ছি। এই প্রবণতা বন্ধ করার ব্যাপারে বাংলা একাডেমির এগিয়ে আসা জরুরি।’

বাংলা একাডেমি সব সময়ই বাঙালির মননচর্চার একটা প্রধান কেন্দ্র। শুরু থেকেই একাডেমি বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যেমন আমাদের একটি শহিদ মিনার দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে বাংলা একাডেমি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে রফিক সালাম জব্বার শহিদ হওয়ার পর যুক্তফ্রন্টের দেওয়া ২১ দফা দাবির অন্যতম ছিল, ‘বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হবে বাংলা ভাষার সাহিত্য নিয়ে গবেষণা।’ সেঅনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা একাডেমি।

বাংলা একাডেমির অহংকারের বিষয়, ১৯৭১ সালের একুশের অনুষ্ঠানমালায় একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রধান অতিথি করে এনেছিলেন ১৯৭০এর নির্বাচনে বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, কোনো সরকারি কর্তাব্যক্তিকে নয়। এ সাহস ও চেতনার জন্য বাংলা একাডেমি সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। যদিও বাংলা একাডেমি সবসময় পছন্দমতো কাজ করতে পেরেছে, এমন নয়। নানা রকম প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এই একাডেমিকে অগ্রসর হতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে সরকারের পক্ষ থেকে নানা বিচিত্র চাপ ও প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেছে বাংলা একাডেমি। বলা বাহুল্য, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হলেও ঢাকা শহরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী ঠিকই উদযাপন হয়েছিলো। কিন্তু বাংলা একাডেমি তা উদযাপন করতে পারেনি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের এক স্মৃতিচারণে জানা যায়, ‘আশির দশকের একটি ঘটনা। একাডেমি কর্তৃপক্ষ আহমদ শরীফকে একটি বিশেষ বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যে ভাষণটি তিনি দেবেন, সেটা আগে ছাপা হচ্ছিল প্রেসে। সেই ভাষণে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে আহমদ শরীফ দুজন বাঙালি নেতাকে বিশেষ সাহসী বলে মন্তব্য করেছিলেন। সুভাষ বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাপার সময় মন্ত্রণালয় জানতে পারে সেটি এবং ওই বক্তৃতা আর আহমদ শরীফের দেওয়া হয়নি।’ সেই বৈরি সময় পার করে এগিয়ে গেছে বাংলা একাডেমি। বলতে গেলে এখন অনুকূল হাওয়া প্রবহমান।

আমরা আশা করি, কামাল চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্ব যখন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন, তখন শুধু বাংলা একাডেমি নয়, দেশের সমগ্র শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। তিনি যেভাবে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন, আশা করি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ শীঘ্রই তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলা একাডেমিকে তৃণমূল পর্যায়ে দেখতে চাই। ১৯৮৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কথাশিল্পী শওকত ওসমান বলেছিলেন ‘বাংলা একাডেমি পৃথিবী অবলোকনের জানালা, জ্ঞানচর্চার বিশাল নিকেতনরূপে কালে কালে বিস্তার লাভ করুক। বাংলাদেশের ঠিকানা হোক বাংলা একাডেমি।’ আমরাও চাই ‘বাংলাদেশের ঠিকানা হোক বাংলা একাডেমি।’

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো

(নম্বর৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেওয়ানী আইনের জাদুকর খ্যাত বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধমহসিন কলেজ ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি