কবি ও মদমাতালের দেশে

জয়দেব কর | শুক্রবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক কবিতার প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা শার্ল বোদলেয়ার বলেছেন, মাতাল থাকতে হবে সবসময়। তা হোক মদে, কবিতায়, ন্যায়নীতিতেযেমন ইচ্ছে, যেভাবে ভালো লাগেসেভাবে। নয়ত সময়ের সুকঠিন ভার মাটিতে নুইয়ে দেবে। উপলক্ষ যাই হোক, সময়ের ক্রীতদাস নাহয়ে মাতাল হওয়াটাই মুখ্য। জীবনের পানশালা মুখরিত করে রাখতে হবে নিজের একান্ত ছন্দদোলায়।

সৃষ্টিমগ্নতার ভেতর দিয়ে যাপিত জীবনের উল্লাস, সকল সুন্দরঅসুন্দরের পরাক্রম কাটিয়ে, আমৃত্যু সচল রাখে যে সত্তাকেসে সত্তাই জীবনের পানশালার প্রকৃত গ্রাহকসেই কবি। সমস্ত মহাজাগতিক উপাদান যেন তার পানপাত্রে ঠাঁই পেতে করে আকুল প্রার্থনানিখিলের সকল স্থিতি যেন গতি পায় তার ছোঁয়ায়। সকল গতি পায় স্থিতি। এই মদমাতালের দেশে তাই কবি ছাড়া বাকি সব আগন্তুক। সকলেই অপ্রস্তুত এমন অকল্পনীয় দৃশ্যকল্পে বাস্তবিক যাদুকরের যাপনে। তার প্রেমে, বিরহে, দ্রোহে, ভালোবাসায় তাই শুধুই অন্য এক চন্দনবনের পোড়া ঘ্রাণ, যা গ্রাস করে নয়ত প্রত্যাখ্যান করে ছড়িয়ে যায় আপন খেয়ালে। এ খেয়াল সৌরভের খেয়াল, এ খেয়াল মাতালের খেয়াল, এ খেয়াল কবিতাযাপনের খেয়াল।

সৃষ্টি আর ধ্বংসের দ্বৈরথে ভারশূন্য উচ্চশির কবিহৃদয় কালের ক্যানভাসে শব্দচিত্রে আঁকে আপন ঐশ্বর্যের চিন্ময় বাক্‌প্রতিমা। অন্তর্গত সুষমায় মাতোয়ারা চোখে নক্ষত্রপুঞ্জের মতো বেদনারা ভর করে থাকে সেই কবিতামানসীর। তার চক্ষুমদিরা পান করে মাতাল পাঠক খুঁজে পায় ব্যধিকে মুক্তোয় রূপান্তরের নির্মল আরোগ্যালয়। রূপান্তরের ঘোড়ার পিঠে সওয়ার আদিমাতাল কবি ধরা দেন তার কাছে দিব্য পানশালা হয়ে। কবিতা না কবি, কীসে বেশি নেশা?

পানশালা বড়োই মনোরম ও কার্যকর ধ্যানালয়। মদ তোমাকে মুখোশ থেকে দূরে সরিয়ে তোমার তুমিকে উন্মোচিত করে। তোমার অন্তর্নিহিত মুক্তো অথবা নিকৃষ্টতম ময়লাটুকুকে তুলে ধরে। মদের বদনাম না করে মলমুখী শুয়োরজীবন পরিত্যাগ করো, নয়ত পূর্ণিমাভরা রাতে মাথা ঊর্ধমুখী না হয়ে বিষ্টাসন্ধানেই জীবন চলে যাবে। যে ভদ্রলোকটি পানশালা থেকে ফেরার পথে উলঙ্গ হয়ে খিস্তিখেউড় দিতে দিতে ফিরছে, যাকে কখনওই স্বাভাবিক অবস্থায় এমন ভাবা যায় না বলে মনে হচ্ছে, তার এই পরিস্থিতির জন্য মদকে কাঠগড়ায় তুলো না। সে আদতে এমনই ছিল। স্বর্ণজলের দিব্য ছোঁয়ায় তার ভীরুতার মুখোশ খুলে গিয়েছে মাত্র। তোমার ব্যক্তিগত প্রীতিঅপ্রীতি, সুকু অথবা অপরের প্রীতিঅপ্রীতি, সুকুযা কিছুই দেখা যায় তার গভীরতর উৎসের সন্ধানে আগে আত্মমদ পানে মাতাল হও, তবেই পথ পাবে, পানশালা তবেই তোমাকে দেবে হৃদয়ের ঐশ্বর্য।

কবিতা ও মদের রসায়নে বাঙ্‌ময় হয়ে ওঠা আমি যেন অনন্ত নৈঃশব্দের আত্মপ্রকাশের ইশতেহার। প্রতিটি অনুচ্চারিত, অশ্রুত ধ্বনীর মর্মমূলে হৃদয় না জীবন কারাগার হয়ে আছে তা মোটেও গুরুত্ব বহন করে না। প্রশ্নটা মুক্তির। পর্দার পর পর্দা সরবে, দৃশ্যের পর দৃশ্য যাবে। মুক্তির পরেও আরেকটা মুক্তি, বৃহত্ত্বের পরে আরও বৃহত্ত্বআমৃত্যু ভ্রমণ। একটা গন্তব্য দেখিয়ে দেয় পরবর্তী গন্তব্যের নির্দেশনা। কোনও চূড়ান্ত গন্তব্য অপেক্ষা করে নেই। কালের যাত্রাপথে আন্তঃনাক্ষত্রিক পাখি হয়ে আমি গাই গান

আহা রে দারুণ মদ কদর্য খোঁয়াড়ে

ফোটালে কুসুম কত প্রেম সুরভির

ভাসালে চুম্বনে শূন্যে আরক্ত জোয়ারে

নারী আর পাখিদের আসুমদ্র তীর।

তোমাকে বেসেছি ভালো অকৃপণ আমি

শুদ্ধ স্বর্ণজল প্রিয়া, তীক্ষ্ম হীরাখণ্ড

নিয়ে আসো মধ্যরাতে সূর্য অস্তগামী

নিঃশ্বাসে ছড়াও মধু জীবন প্রচণ্ড ।

চারপাশে পিশাচেরা এমন উল্লাসে

তোমাকে বিপন্ন করে , বিষণ্ন আমায়;

প্রেমের তরল ঠোঁটে হৃদয়ের ত্রাসে

আমাকে উদ্ধার করো মাতাল আভায়।

তুমি আর আমি শুধু আছি যূথবদ্ধ

কবিতার শব্দঘরে অমরঅবধ্য।

মদ/জয়দেব কর (অস্ত্রাগার হয়ে যাক জাদুঘর)

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালদায় অভিযান, ৭ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ
পরবর্তী নিবন্ধলালন ফকির-পতিতজনের বন্ধু