মরহুম কবি ওহীদুল আলমের জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর পিতা মৌলভী নসিহ্ উদ্দিনের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস উল্লেখ করা প্রয়োজন। জানা যায়, শাহ্ বাকের ও শাহ্ সুলতান দুই ভাই গৌড় থেকে এসেছিলেন এ অঞ্চলে। শাহ্ বাকেরের দুই ছেলে লুৎফুল্লাহ ও আমানুল্লাহ্ হাটহাজারী থানার ফতেপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
লুৎফুল্লাহ্র বংশধরদের মধ্যে মোহাম্মদ সগীর ও মোহাম্মদ আকবর শিক্ষা শেষ করে অধ্যপনায় নিয়োজিত হন।
মোহাম্মদ আকবরের পুত্র মোহাম্মদ রওশন কৃতবিদ্যায় দিক্ষিত হয়ে সাহিত্য কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ছিল মুলুকুন্নেছা ওয়ান।
মোহাম্মদ আকবরের আরও তিন পুত্রের নাম হচ্ছে ১. খোন্দকার মোহাম্মদ আফজল,
২. মুন্সী ওলিউদ্দিন, ৩. মুন্সী বোরহান উদ্দিন।
মুন্সী ওলিউদ্দিন কৃতবিদ্যা, সরকারি চাকুরে, শিক্ষাব্রতী, আধ্যাত্মসাধক এবং সাহিত্যিকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
মুন্সী ওলিউদ্দিনের একমাত্র পুত্র মৌলভী ফসিহউদ্দিন। তিনি চট্টগ্রামের বিখ্যাত আলেম মৌলানা আবুল হাসানের নিকট শিক্ষা সমাপন করেন। মৌলানা আবুল হাসান চান্দগাঁও অঞ্চলের বিখ্যাত আলেম (মদিনা–ই ইলম) বিদ্যার জাহাজ নামে খ্যাত ছিলেন।
মৌলভী ফসিহ্ উদ্দিনের প্রথম স্ত্রীর গর্ভে দুই কন্যার জন্ম হয়। ১. বদিউন্নিসা,
২. খোররন্নেসা।
তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তিন পুত্রের জন্ম হয়। তাঁরা যথাক্রমে মৌলভী সবিহ্ উদ্দিন, মৌলভী মলিহ্ উদ্দিন ও মৌলভী নসিহ উদ্দিন। ফতেপুর অঞ্চলে তাঁরা বড় মৌলভী, মাইজ্যা মৌলভী ও ছোট মৌলভীর নাম সুপরিচিত ছিলেন। সে যুগের নিয়মানুসারে তাঁরা তিন ভাই আরবি ও ফার্সি ভাষায় জ্ঞান লাভ করেন।
মৌলভী সবিহ্ উদ্দিন বংশের কেউ বেঁচে নেই।
মৌলভী মলিউদ্দিনের প্রথম পুত্র আব্দুল মোমেন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা করে গেছেন। তাঁর একমাত্র কন্যা ফাতেমা সাহিত্য চর্চায় খ্যাতি অর্জন করেন।
মৌলভী মলিহ্ উদ্দিনের ২য় পুত্র আব্দুর রউফ সমাজকর্মী ছিলেন। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ছিল। ১৯৪০ সালে তাঁর একটি ছোট নাটক ‘এরাও মানুষ’ শ্রমিক জীবন নিয়ে রচিত হয়। ৩য় পুত্র আবদুল রব তিনি নিউ স্কিম মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। তিনি এ বংশের আরবি শিক্ষার একমাত্র ধারক ছিলেন। ৪র্থ পুত্র আবদুস সালাম একজন কবি ছিলেন। তাঁর লিখিত কবিতা গ্রন্থ ‘আচড়’ ও আখেরি গজল। তিনি দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ভাল আবৃত্তিকার ছিলেন। চট্টগ্রাম বেতারে তিনি চাকরি করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি অনেক সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন। ৫ম সন্তান আব্দুল কুদ্দুস ‘সমাজ’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ও সাহিত্য চর্চা করতেন।
মৌলভী ফসিহ্ উদ্দিনের কনিষ্ঠ পুত্র মৌলভী নসিহ্ উদ্দিন সংস্কার মুক্ত উদার প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যুগোপযোগী সন্তানদের জ্ঞান অর্জন করবার দিক বিবেচনা করে নিজ পিতামহ ও পিতৃভিটা ফতেপুর ত্যাগ করে ফতেয়াবাদে আবাস স্থাপন করেন। সে যুগে ফতেয়াবাদে অনেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। মৌলভী আরবি, ফার্সি পড়ুয়া বাংলা কিছুটা জানতেন। তিনি কিছু পুঁথি রচনা করেছিলেন যা অপ্রকাশিত রয়েছিল। তিনি বিচারকার্য সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতেন বলে বাড়িতে পাড়া, মহল্লায় তাঁকে সকলে শ্রদ্ধা করতেন।
মৌলভী নসিহ্উদ্দিনের চার পুত্র যথাক্রমে– শামসুল আলম, মাহবুবউল আলম, দিদারুল আলম ও ওহীদুল আলম।
মৌলভী নসিহ্উদ্দিনের প্রথম পুত্র শামসুল আলম অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন। ১৯১১ সালে তিনি ফতেয়াবাদ স্কুল থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় জেলাতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সে যুগে মেধার দিক দিয়ে হিন্দু ছাত্ররা অগ্রণী ছিল। মুসলমান ছাত্র বৃত্তি লাভ করা অতি বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। ১ম স্থান অধিকারী ছাত্র শামসুল কলেজিয়েট স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। মুসলিম ছাত্র হওয়ায় প্রথমে তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। পরে যখন তাঁর বৃত্তির কৃতিত্বের কথা শিক্ষকগণ জানলেন তখন তাঁকে স্বাগত জানানো হলো। ঐদিকে ফতেয়াবাদ স্কুল শামসুল আলমের কৃতিত্বের জন্য সে বছরই হাইস্কুলে পদার্পণ করলো। তিনি কলেজিয়েট স্কুলে থাকাকালীন সময় প্রতিভার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।
পরবর্তীতে আলম পরিবার চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌলভী নসিহউদ্দিনের দ্বিতীয় পুত্র মাহবুবউল আলম ফতেপুর গ্রামে ১৮৯৮ সালে ১ মে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে ফতেপুরে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। ১৯১২ সালে তিনি ফতেপুরের করিম বক্স ফতেয়াবাদ স্কুল থেকে ইংরেজি বৃত্তি লাভ করেন। নিচের ক্লাসে তিনি ডবল প্রমোশন পান। বৃত্তি পাবার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র দেখে ফতেয়াবাদ স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে সে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯১৫ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তাঁর এ কৃতিত্বে ফতেয়াবাদ স্কুলে বিশেষ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তারপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে আই.এ ক্লাসে ভর্তি হন। বাবার সংসারের অসচ্ছলতার কারণে তাঁর আই.এ পড়া অসমাপ্ত রেখে কলেজ ত্যাগ করেন। সুদূর ফতেয়াবাদ থেকে শহরে এসে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া ব্যয় বহুল ছিল। তিনি বড় ভাইয়ের মতো অস্থির ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত ধীরস্থির ও বিবেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন।
মাহবুবউল আলমের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লিখিত ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল’ প্রথমে দৈনিক জমানায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় পরে তা পুস্তুকরূপে রচিত হয়। তাঁর লিখিত বইগুলো কারো অজানা নেই। মোমেনের জবানবন্দী, পল্টন জীবনের স্মৃতি, গোঁফ সন্দেশ, মফিজন, চট্টগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ম্যাট্রিক পাশ হলেও তাঁর লিখিত পুস্তক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমে রয়েছে। তাঁর একটি বাক্য সকলের মনে গেঁথে আছে, তা হলো, ডক্টর নই প্রফেসর নই, আমি সাহিত্যির দিনমজুর’। বাস্তবে তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন। মৌলভী নসিহর ৩য় পুত্র দিদারুল আলম ১৯০৩ সালের দেশভাগে ফতেপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দিদার ফতেয়াবাদের নন্দীর হাটে বড় স্কুলে লেখাপড়া করেন। শ্রেণির শ্রেষ্ঠ পড়ুয়া হিসেবে তিনি ঐ স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এ সময় তিনি আরবি ও ইংরেজি শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলে বড় ভাই তাঁকে নিউ স্কিম মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। তিনি সাহিত্যিক আবুল ফজলের সহপাঠি ছিলেন। বৃত্তি লাভের পর প্রিন্সিপাল কামাল উদ্দিন আহমদের দৃষ্টি তাঁর উপর পড়ে। দিদার মাদ্রাসার ৮ম শ্রেণি অধ্যয়নকালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তিনি প্রচলিত শিক্ষায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে মাদ্রাসা ত্যাগ করেন। এরপর তিনি চাষাবাদ, মোটর ড্রাইভিং ইত্যাদি করে পারিবারিক সচ্ছলতা আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি কবিতা লিখতে থাকেন। ১৯২১ সালে সাধনাতে তাঁর প্রথম কবিতা বিমুখ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯২৪ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে রেঙ্গুন চলে যান। তিনি তখন থেকে তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘ফয়ার দেশে’ লিখে ফেলেন।
১৯২৯ সালে দিদারের আমন্ত্রণে কবি নজরুল ইসলাম তাঁদের বাড়িতে আসেন। রাত্রি যাপন করেন। অনেক গান, কবিতা রচনা করেন এখানে। কবি নজরুল দিদারের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বন্ধুত্বে পরিণত হন। তার সাথে কাজী আব্দুল ওদুদ, আবদুল কাদির, কবি শাহাদাৎ হোসেন, সাহিত্যিক ডা. দীনেশ সেন, কল্লোল সম্পাদক দীনেশ রঞ্জন, সম্পাদক মি. সুরেশ চন্দ্র ঘটক, গল্প লেখিকা এস ফাতেমা প্রভৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর অন্যতম বন্ধু ড. বেণীমাধব বড়ুয়া ও প্রিন্সিপাল কামালুদ্দীন আহমদের সহায়তায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে ‘টিপু সুলতান’ সম্বন্ধে গবেষণামূলক অধ্যয়ন করতে থাকেন।
মৌলভী নসিহর চতুর্থ ও সর্বকনিষ্ঠ পুত্র
ওহীদুল আলম ১৯১২ সালে ১ জানুয়ারি হাটহাজারী জেলার ফতেয়াবাদে জন্মগ্রহণ করেন। ফতেয়াবাদ স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ফতেয়াবাদ হাই স্কুল থেকে তিনি ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুল জীবনে বিশিষ্ট সমাজকর্মী বাদশা মিঞা তাঁর স্কুল সহপাঠী ও পরম বন্ধু ছিল। ১৯৩৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে তিনি প্রথম বিভাগে আই.এ পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৩৬ সালে তিনি বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। সাহিত্যিক ও অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন তাঁর কলেজ সহপাঠী ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অগ্রজ তিন ভাইয়ের মতো তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি মূলত একজন জাত কবি ছিলেন। বাংলার পাহাড়, নদী, সাগর, বন–বাদাড়, পল্লীর মেঠোপথ, দীঘির কালোজল, খাল, বিল পুকুর, পাখির কুঞ্জন চন্দ্র, সূর্য, তারকা স্রষ্টার সৃষ্টির অপরূপ রূপে তিনি মোহিত ছিলেন। উদার, উদাসীনতা প্রকৃতি প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তিনি যে কাব্য রচনা করতেন তাকে প্রথমে কবি ওহীদুল আলম নামে আখ্যায়িত করা হতো। কিন্তু তিনি কবিতা লিখায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, ইতিহাস, অলি দরবেশের জীবনী, স্কুল, পাঠ্য বই, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ গল্প ইত্যাদি। তিনি প্রত্যুষে কোরান শরীফ পাঠ করতেন আল্লামা ইউসুফ আলীর ইংরেজি তর্জমা পড়ে কোরানের অর্থ বুঝতেন এবং মর্ম উপলব্ধি করতেন। তিনি প্রায় ২৩টির মত বই প্রকাশ করেন। এছাড়া তাঁর অনেক পান্ডুলিপি অপ্রকাশিত রয়েছে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো– ১. কর্ণফুলির মাঝি, ২. জোহরার প্রতীক্ষা, ৩. পৃথিবীর পথিক (আত্মজীবনী), ৪. মুকুলিকা (স্কুল পাঠ্য বই), ৫. ছুটির গল্প, ৬. কয়েকটি সেরা গল্প, ৭. চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য, ৮. বাঙলা জীবনী কোষ, ৯. চট্টগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদি। তিনি দৈনিক আজাদীতে প্রতি সপ্তাহে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শিরোনামে কলাম লিখতেন। তিনি সাংবাদিকতা করে গেছেন। তাঁর সাহিত্য কীর্তির জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননা ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর আর এক উজ্জ্বল কর্ম রেখে গেছেন আদর্শ শিক্ষকতা। ১৯৩৮ সালে ২ জুলাই সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে তাঁর প্রথম চাকরি হয়। সাহিত্যিক আবুল ফজলের লিভ ভেকেন্সিতে তিনি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি জে.এম সেন স্কুলে দুই মাস চাকরি করেন। তারপর তিনি সাতকানিয়া সার্কেলের সাব ইন্সপেক্টর পদে আড়াই মাস চাকরি করেন। ১৯৪১ সালে তিনি পটিয়া রাহাত আলী স্কুলে প্রায় দুই বছর যাবত শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ফটিকছড়ি হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োজিত হন। ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি শিক্ষা জগতের বাইরে সেন্সর অফিসার হিসেবে চাকরিরত থাকেন। ১৯৪৫ সালের ৮ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ইংরেজি শিক্ষকরূপে নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে তাঁকে বরিশালে বদলি করা হলে তিনি তা কাটিয়ে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বহাল থাকেন কলেজিয়েট স্কুলে নিয়োগ পাবার আগ পর্যন্ত।
১৯৫৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ওহীদুল আলম চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাইস্কুলে যোগদান করেন। দীর্ঘ ১৩ বৎসর ঐ স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত থেকে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম জুনিয়র ট্রেনিং কলেজে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল তিনি সরকারি চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ক’বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হাইস্কুলে বেসরকারিভাবে চাকরি করেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবন দীর্ঘ প্রায় ৩৮ বৎসর কাটে। বিভিন্ন স্কুলে চাকরি করায় বিশেষ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাই স্কুলে চাকরি করায় তাঁর ছাত্র সংখ্যার পরিমাণ কম নয়।
আমার বাবা ওহীদুল আলমের পাঠদান পদ্ধতি ব্যতিক্রম ছিল তিনি এমন আকর্ষণীয়ভাবে পড়াতেন তাতে অমোনযোগী ছাত্ররাও পাঠে মনোযোগ দিতে বাধ্য হতো। তিনি শান্ত ঠাণ্ডা মেজাজের ছিলেন। হাতে কখনও বেত নেন নাই, পড়া না বুঝলে বারবার বুঝিয়ে দিতেন, এতে ছাত্ররা তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। বাংলা, ইংরেজি খুব ভাল পড়াতেন। স্কুল পাঠ্য বইয়ের পড়ার সঙ্গে তিনি আনুষঙ্গিক নানা তথ্য উপস্থাপন করে পড়াকে সহজলভ্য করে দিতেন। বাংলায় রবীন্দ্র, নজরুল, জসীমুদ্দিন, সত্যেন্দ্রনাথ, মাইকেল, মোহিত লাল প্রত্যেকের কবিতা ছন্দে ও তালে আবৃত্তি করে সঙ্গে অর্থ বুঝিয়ে দিতেন। আমরাও বাবার কাছ থেকে ম্যাট্রিক, আই.এ তাঁর শিক্ষায় পড়া শিখতে সহজভাবে পড়া রপ্ত করেছি। সেভাবে ইংরেজি কবিতাগুলো তিনি পড়াতেন তাতে আমরা সহজে পারতাম, সহজে হৃদয়ঙ্গম হতো। তাঁর ইংরেজি শেখাবার কৌশল ছিল বেশি করে ট্রান্সলেশন করা। এর মাধ্যমে গ্রামারও শেখা হতো। মাইকেল মধুসূদনের অতিমাত্রার ছন্দের কবিতা পড়ার স্টাইল তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন। অনেক সময় আমার ছেলে–মেয়েরা পড়ার সময় নানার সাহায্য পেয়েছে। তারা তার ইংরেজি জ্ঞানের পরিধি দেখে বলতো নানা তো একেবারে ডিকেশনারি। বাংলা, ইংরেজি ছাড়া ফার্সি কবিতাগুলো অঞ্জলি মুখস্থ বলার সঙ্গে অর্থ বলতে পারতেন। আবার কোরানের আয়াত পড়ে সাথে সাথে তার তর্জমা করা এ এক অদ্ভুত জ্ঞানী লোক ছিলেন।
ওহীদুল আলম জ্ঞান সাধক হলেও নিজের কন্যাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিপক্ষে ছিলেন। পুত্র সন্তানদের শিক্ষিত করার যে বাসনা তার ব্যক্তি জীবনে দেখা যায় তা কন্যাদের বেলায় অনুপস্থিত ছিল। ফলে স্কুলের গন্ডি পেরুনোর আগেই তিনি চার কন্যাকে পাত্রস্থ করেছিলেন।
মৌলভী নসিহর চার পুত্রের জ্ঞান প্রতিভা বংশানুক্রমভাবে পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া। তাঁদের অসাধারণ জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শাণিত ধারায় প্রবাহিত হয়ে মহীরূহ রূপ ধারণ করেছে।
আমার বাবার দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা জীবনে কিছু স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি বাবার ছাত্র ছিলেন। যেমন ডা. ইউসুফ (প্রয়াত), ড. আবদুল করিম (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন উপাচার্য ও ইতিহাসবিদ) ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদ (প্রয়াত), ড. ইব্রাহিম, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর (প্রয়াত), ড. নুরুল ইসলাম, ডা. জিল্লুল হাসান, ড. জাফর ইকবাল, কবি ও সাহিত্যিক আবুল মোমেন, ডঃ. মোহিত উল আলম (সাহিত্যিক ও সাবেক ভিসি) ড. মাহবুবুল হক প্রমুখ।
বাবা ধার্মিক ছিলেন কিন্তু গোঁড়ামি ছিল না। তিনি আবেগী ছিলেন তাই রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, পল্লীগীতি, কাওয়ালি, গজল, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান করতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। মেজ জেঠা গানের ধারে কাছে ছিলেন না। কিন্তু বাবা গান করতে গিয়ে কোথায় হারিয়ে যেতেন তিনি নিজেও তা বুঝতে পারতেন না।
সকাল বিকাল রাস্তায় হেঁটে চলা বাবার নিত্যকার রুটিন ছিল। এতে মানুষজনের সাথে আলাপচারিতা হতো, কুশল বিনিময় হতো, তাঁর মনে ফূর্তি থাকতো। তিনি তাঁর নিজের মেয়েদের বাসায় যেমন যেতেন সে রকম ভাইপো, ভাইঝিদের বাসায় যেতেন। তিনি বলতেন এ হাঁটাহাঁটিতে রাতে ঘুম ভাল হয়। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে একা রাস্তায় চলা বিপদ তো আসবে। কারণ তখন শারীরিক অক্ষমতা ও হুশজ্ঞান মানুষের লোপ পেতে থাকে। অষ্টাশিতে পা দিয়ে তিনি হাঁটতে পারতেন ভাল। এই পারাটাই তাঁর জন্য বিপদ হলো। সেদিন বাসে করে ফতেয়াবাদ গিয়েছিলেন। বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হতে গিয়ে সিএনজির ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলেন। সিএনজি ড্রাইভার পালিয়ে না গিয়ে তাঁকে সিএনজিতে তুলে নিলো। ততক্ষণে লোকজন এসে ড্রাইভারকে মারধর করতে চাইলো, জনতা উত্তেজিত হলো। কিন্তু তাঁর হুশ ছিলো তাই তিনি হাত নেড়ে সবাইকে বাধা দিলেন, বললেন ড্রাইভারের কোন অপরাধ নেই দোষ আমার– কেউ তার ক্ষতি করবেন না। ড্রাইভার তাঁর বাড়িতে তাঁকে দিয়ে গেলেন। তাঁর ভাইপো আনোয়ার তাঁকে ক্লিনিকে ভর্তি করালেন। ডাক্তারেরা অবহেলা করলো সুচিকিৎসা দিল না। জখমস্থানে রক্তক্ষরণ বন্ধ করলে হয়তো সুস্থ হতে পারতেন। তবে হায়াত না থাকলে কেউ বাঁচাতে পারে না। কথা আছে মারে আল্লাহ রাখে কে। হাসপাতালে যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় তখন আমার মেজ সন্তান কামরুল একাই সেবাযত্ন করে নানার মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছিল। সেদিন ছিল ১৯৯৮ সালের ২৪ জানুয়ারি রমজান মাস ইফতারের সময় আমার বাবা ওহীদুল আলম চিরবিদায় নিলেন। আল্লাহপাক সুবহানাল্লাহ তালা তাকে বেহেশত নসীব করুন, আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমিন।
লেখক : কবি–সাহিত্যিক।