পৃথিবীজুড়ে তারুণ্যের জয়জয়কার। তরুণরা হলো অগ্রসর চিন্তার মানুষ। তারা যা ভাবতে পারে, অন্যরা তা ভাবতে পারে না। তারা চিন্তাচেতনায় যেমন নতুন, তেমনি কর্মে উদ্দীপনাময়। তারা অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে এগিয়ে যায়। প্রেম করে, বিদ্রোহ করে। তারা কবিতা লেখে, গান করে, আবৃত্তি করে। তারা অন্যের ভেতরে জাগ্রত করে মানবিকতা। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয়োজিত একুশের বইমেলায় এক তরুণের সদ্য প্রকাশিত কবিতার বইয়ের পাঠ–উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। তার নাম মিজবাহুল জান্নাত তারিন। সে তার ‘কথা ছিলো সুবিনয়’ বইটি নিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে ছিলেন প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান ও অধ্যাপক বশির উদ্দিন কনক। বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা ‘দূরবীণ’। তারিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। বইয়ের ফ্ল্যাপে তার কথাগুলো পড়ে চমকে উঠলাম। সে লিখলো: ‘অপরিপক্ক হাতে অগোছালো প্রাসাদ ছুঁতে ভীষণ অপারগ আমি। আমি ঠোঁটের কোণে চার্মিং হাসি মেখে যন্ত্রণা লেনাদেনার তৃষিত আর্টিস্ট। সমালোচনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কিংবা আত্মসম্মানকে ডমিনেট করে সৃষ্টিকর্তা চাইলেই একদিন হয়তো তেজ কিনব, বিক্রি করব জেদ। যে সমাজ জাজমেন্টাল পিস খুন করে, উচ্ছৃঙ্খল চোখে আমি সে সমাজে মস্তিষ্কের ভাবনা একচেঞ্জ করি।’ তার নিজের কথাগুলোর মতো কবিতার পঙক্তিগুলোও ঝাঁঝালো, তীক্ষ্ণ ও উজ্জ্বল। প্রতিটি কবিতায় আছে নিপুণ ব্যঞ্জনা, যে ব্যঞ্জনাশক্তির গুণেই সৃষ্ট হয় ‘প্রতীক–উপমা–রূপক–উৎপ্রেক্ষা–চিত্রকল্পের অন্তহীন জগৎ’। মিজবাহুল জান্নাত তারিন দেশ, জাতি ও সমাজ নিয়ে ভাবে, মানুষ নিয়ে ভাবে, প্রেম–দুঃখ–যন্ত্রণা নিয়ে ভাবে। সে–সব ভাবনা কবিতায় রঙিন তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলে সে।
আমার ভালো লাগার অন্যতম কারণ হলো তার মতো অনেকেই এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যচর্চা করছে। সেখানে তরুণদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে আমার। তাতে দেখলাম সাহিত্যের প্রতি তরুণদের আগ্রহ। আমি তাদের এ প্রয়াসকে অভিনন্দন জানাই।
এবারের বইমেলায় অনেক তরুণের কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। যাদের প্রথম বই প্রকাশিত হলো, তাদের আনন্দের সীমা নেই। বেরিয়েছে মুকুল চৌধুরী ‘জল দিয়ে জল ছুঁই’, তারিফা হায়দারের ‘উড়ে যায় বিহঙ্গ মন’, প্রতিমা দাশের ‘চলো স্বপ্ন বুনি’, কাজী জাহাঙ্গীরের ‘ছুঁয়ে দাও অনামিকায় বসন্ত বাথান’ প্রভৃতি।
২.
‘কবিতা’ হিসেবে যে সব লেখা দৈনিক সাহিত্য সাময়িকীসহ বিভিন্ন দিকে মুদ্রিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই কবিতা নয়–এ ধরনের একটা অভিযোগ চালু আছে। এরকম অভিযোগও শোনা গেছে যে, ‘গত পাঁচ দশকে যে সব কবিতা লেখা হয়েছে, তার মাত্র কিছু আধুনিক, কিছু আংশিক আধুনিক এবং অধিকাংশই অনাধুনিক ও কবিতা নয়, নতুনও নয়।’ এই যে কোন্টা কবিতা এবং কোন্টা কবিতা নয়, তা নির্ণয় করা হয় কীভাবে! কবিতা যাচাইয়ের মানদণ্ডই বা কী! কবিতার জন্যে সর্বসম্মত মানদণ্ড কখনো হয় নি, হবেও না। যেখানে কবিতার অভিন্ন সংজ্ঞা নেই, যেখানে কবিতা বিভিন্ন জনের কাছে বিশ্লেষিত হয়েছে বিভিন্নভাবে, সেখানে কবিতা যাচাইয়ের মানদণ্ড কি অভিন্ন থাকতে পারে!
যেহেতু কবিতা মনের উৎসারণ, কবি মানসের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং যেহেতু কবিতা অনুভব–উপলব্ধির জিনিশ, সেহেতু পাঠকের হৃদয়ঙ্গমের মধ্যেই কবিতার সার্থকতা। কোন্ কবিতা কাকে স্পর্শ করতে পারে, তা আগে থেকেই অনুমান করা কঠিন। কেননা, যে পংক্তি আমাকে আলোড়িত করেছে, অভিভূত ও মুগ্ধ করেছে, সেই পক্তিটি একইভাবে অন্যজনের মনকেও নাড়া দেবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? প্রতিটি মানুষের মনোজগত স্বতন্ত্র ও ভিন্ন। কারো মনের সাথে কারো মতের মিল থাকতে পারে, তবে অনিবার্য নয়। তাই একটি কবিতা একজনের কাছে চমৎকার, অন্যজনের কাছে তুচ্ছ। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘জ্ঞানের ক্ষেত্রে, বস্তুর ক্ষেত্রে যে মতবদল হয়, কোনো একটা তথ্যে তার ভিত্তি থাকে বলে তার তবু একটা দিক পাওয়া যায়, কিন্তু রসের জগতে কখন যে কোনদিক থেকে হাওয়া দেয় তার কিছুই বলা যায় না– ভাবখানা এই রকম যেন সমস্তটাই একটা বিশুদ্ধ খামখেয়াল। আসলে রসের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই পরিমাপ করা যায় না, প্রমাণও করা যায় না। এক জনের মনের সাথে অন্যজনের মনের যে অমিল থাকতে পারে, তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের মনও কি সব সময় নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে? যে জিনিশকে সুন্দর ভোরে অপূর্ব মনে হয়েছে, বিকেলের ম্ল্লান ও বিষণ্ন বেলায় তাকে মনে হতে পারে বাতিল পণ্য। গাড়ি চড়ে অফিসে যাওয়ার পথে যে গানের সুর মনকে জাগিয়ে তুলেছে, এক বৃষ্টি ঝরা দিনে তা হয়তো মনের কাছে বেসুরো ঠেকছে।’ তাই বলতে চাই, মনকে তুষ্ট করার ব্যাপারটা আপেক্ষিক। যে সব কবিতাকে আমরা ‘কবিতা নয়’ বলে বাতিল করে দিচ্ছি হয়তো অনেকেরই অজান্তে সেই সব কবিতা বহু মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
কবিদের মধ্যে সকলের শক্তি সমান নয়, সকলের সামর্থ্য এক নয়। তেমনি পাঠকের মধ্যেও আছে এই বিভক্তি, আছে অপূর্ণতা। মাধ্যমিক শ্রেণি পাশ পাঠক আর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ পাঠকের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই। অর্থাৎ পরিণত আর অপরিণত পাঠকের ব্যবধান। তাই কবিতার রসগ্রহণ সবাই একই বিচারে করতে পারে না। ফলে কবিকে তাঁর পাঠকের দিকে তাকিয়েও অনেক সময় কবিতা নির্মাণ করতে হয়। এজন্য হুইটম্যান বলেছিলেন, ‘যে দেশের পাঠক যত বেশি অগ্রগামী, সে দেশের কবিতা তত বেশি সমৃদ্ধ’। কোন কবিতাটি গভীর এবং কোন কবিতাটি অগভীর, সেটা নির্ণয় করা যতটুকু সহজ, কোনটি কবিতা, কোনটি কবিতা নয়–তা’ নির্ণয় করা ততটুকু কঠিন, যদি সেই লেখাটির ভেতরে পাঠককে তুষ্ট করার ক্ষমতা থাকে, সুর থাকে, ভাব থাকে। সকল কবিই চান, তাঁর নির্মিতব্য কবিতাটি হোক গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক, যদিও গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক করার পেছনে প্রয়োজন কবির মেধা ও শক্তি। যিনি যত বেশি ক্ষমতাবান ও মেধাবী, তাঁর কবিতাও তত সুন্দর ও সমৃদ্ধ। তবে শব্দের আধুনিকতা, বাক্যের আধুনিকতা, ছন্দের আধুনিকতা, তথা উপস্থাপনার আধুনিকতা থাকলেই সেই রচনাটি হচ্ছে আধুনিক।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, কবিতার সাথে তারুণ্যের সম্পর্ক অটুট। সে জন্য কবিতা তরুণদের হাতেই তার দিক পরিবর্তন করে, বাঁক নেয় নতুনের দিকে। আবেগ, উচ্ছ্বাস, কৌতূহল সব মিলিয়ে কবিতা হয়ে ওঠে তারুণ্যময়।
মোট কথা, কবিতা একজন কবির আবেগাশ্রিত শব্দের নিটোল সমাহার, ভাবরসে টইটম্বুর এক উজ্জ্বল সরোবর, ছন্দের অপূর্ব ঝংকার। এটা সৃজনশীল একটা শিল্প। কবিতা অন্তরের বিষয়, অনুভব–উপলব্ধির বিষয়। ফলে কবিতার পরিমাপ তার রহস্যে, তার লাবণ্যে এবং তার জাদুতে।
৩.
এবারের বইমেলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এসেছে, যা উল্লেখ না করলেই নয়। তন্মধ্যে রয়েছে কবি ময়ুখ চৌধুরীর ‘নীরবতা ছিল, আজও থাক’, খুরশীদ আনোয়ারের ‘কাব্য সমগ্র : ১’, চৌপদী কাব্যগ্রন্থ ‘রুহের শায়েরি‘, গানের বই ‘গানের সিন্দুক‘, ‘প্রেম শহরের পথে, ওমর কায়সারের ‘ক্ষুধা ও কপিলা’, মহীবুল আজিজের গল্পগ্রন্থ ‘রোববার মৃত্যুবার‘, কাব্যগ্রন্থ ‘এ্যান আমাকে বলো‘, ‘মঁতাজ ও অন্যান্য সনেট‘, ‘মেলা দিন বেঁচে আছি‘, ‘হেনরি থোরু‘র কাছে‘, ‘এইসব লাল দিন’, প্রবন্ধগ্রন্থ ‘এইসব শব্দকথা‘; হোসাইন কবিরের ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ‘অগ্নিজলে সুগন্ধশরীর’, শুক্লা ইফতেখারের ‘একান্নবর্তী আকাঙ্ক্ষা’।
এবারে সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে মহীবুল আজিজের। একটি প্রবন্ধগ্রন্থ ও একটি গল্পগ্রন্থ মিলিয়ে মোট ৮টি গ্রন্থ এসেছে তাঁর। বলা যায়, চট্টগ্রামের মেলার জন্য এটি একটি আনন্দ সংবাদ। মহীবুল আজিজ দেশের সাহিত্যাঙ্গনে এক মেধাবী ও বিশিষ্ট মুখ। সাহিত্যের প্রায় সব ক’টি শাখায় তাঁর বিচরণ স্বতঃস্ফূর্ত। প্রবন্ধ, গবেষণা, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও অনুবাদে তিনি একজন দক্ষ কারিগর। নানা ক্ষেত্রে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর সপ্রতিভ সক্ষমতা। লেখায়, বলায়, জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, শিক্ষায় তিনি এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতার ভাষা যেমন অসাধারণ, তেমনি গল্প বলার ভঙ্গিও ব্যতিক্রম। তাঁর সমস্ত রচনা দাবি করে সচেতন পাঠকের গভীর মনোনিবেশ। সমালোচকদের মতে, ‘গল্পকার মহীবুল আজিজ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ভিড়ের মনস্তত্ত্ব গল্পে ব্যক্তিগত উপস্থিতির এক পরিসর তৈরি করতে পেরেছেন।’
৪.
কবিতা আরাধনার বিষয়। এটি একটি নির্মাণকলা, অন্যান্য শিল্পের মতো একেও নির্মাণ করতে হয়; যদিও সবার নির্মাণশৈলী মৌলিক ও নান্দনিক হয়ে ওঠে না। কেননা ছন্দ–অলংকার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও অপরূপ শব্দ–যোজনায় নির্মাণ করা হয় কবিতার বসতবাটি। এটি সহজাত শিল্পসৌকর্যে যতটা উজ্জ্বল ও প্রাণময় হয়ে উঠবে, ততই পাবে ব্যাপকতা।
কবিদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্যণীয়; সেটা হলো বৃত্ত ভাঙার প্রচেষ্টা। তরুণ বয়স থেকে তাঁর ভিতরে এমন উন্মাদনা তৈরি হয়, তিনি ইচ্ছে করেন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে চারপাশ কাঁপিয়ে কাব্য রচনায় ব্রতী হতে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ কবিরা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটান এবং কাব্যের মহৎ ভাব ও উত্তাপকে কালান্তরে উৎসারিত করেন। তাঁরা আয়োজন করেন আলোর মহা–উৎসব। সেই উৎসবেই কবিতার ব্যাপকতা, বিশালতা ও বিস্তৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যান ঝরনাধারার মতো। একসময় তাঁদের মাথায় উঠে আসে সাফল্যের মুকুট।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।