২য় পর্ব
বাংলাদেশের প্রায় সকল সেরা পরিচালকের সঙ্গে কবরী কাজ করেছেন। সুভাষ দত্তের হাত ধরে প্রথম ছবি ‘সুতরাং’ এ অভিনয়ের পর দ্বিতীয় অভিনয়টি করেন জহির রায়হানের ‘বাহানা’ ছবি যেটি সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি। কিন্তু এটা নিয়ে তাঁর কোনো অহমিকা বোধ ছিল না। সব পরিচালককে সমান চোখে দেখতেন, যেটা তাঁর নির্মল পেশাদারিত্বের বহিঃপ্রকাশ।
রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর রসায়ন ছিল অত্যন্ত মানানসই। ফলে এই জুটি কয়েক প্রজন্ম ধরে জনপ্রিয় ছিল। তবে কবরী প্রায় সকল নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। সুভাষ দত্ত, উজ্জল, জাফর ইকবাল, ফারুক, সোহেল রানা, চঞ্চল মাহমুদ, আলমগীর এদের ডেব্যু বা প্রথম নায়িকা কবরী। প্রযোজক পরিচালকেরা নিশ্চিন্ত থাকার জন্য হয়তো এটা করতেন। পক্ষান্তরে লাভবান হতেন নতুন নায়কেরা।
কবরীর জীবন কখনো একরৈখিকভাবে বয়ে চলেনি। চলচ্চিত্রে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি নিজেকে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কবরীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বিভিন্ন শহরে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন সম্পর্কে জানানোর উদ্দেশ্যে। কোলকাতা ও মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। মুম্বাইতে আইএস জোহরের প্রযোজনা পরিচালনায় ‘জয় বাংলা’ বলে একটি ছবিতে অভিনয় করেন যদিও ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কবরী অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচেয়ে বড় কাজ, সলিল চৌধুরীর লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা, ‘আমি মজিদের মা বলছি’র পাঠাভিনয়। সলিল চৌধুরীর লেখায় ও সংগীতে আলেখ্যটি মেগাফোন কোম্পানি ৪৫ আর পিএম ফর্ম্যাটের গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশ করে এবং রেকর্ডটি প্রচুর বিক্রি হয়, যে অর্থ জমা হয় প্রবাসী সরকারের তহবিলে। পরে রেকর্ডটি ক্যাসেট ও সিডি আকারেও প্রকাশিত হয়। কবরী তাঁর আত্মজীবনীতে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি সেখানে এক জায়গায় লিখেছেন,
‘‘যদিও প্রথমে শ্রীমতি সুচিত্রা সেনকে দিয়ে সেটা রেকর্ড করবার কথা ছিল। সলিলদা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কথা চিন্তা করে আমাকে নেন। শিরোনাম দেন ‘আমি মজিদের মা বলছি।’ পুরো স্ক্রিপ্টে যুদ্ধের ভয়বহতা, অত্যাচার, নির্যাতন, এইসব উঠে আসে। অকৃত্রিম আবেগে সত্যিকারের চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আবৃত্তি করে অভিনয় করি।”
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠ সৈনিক হিসেবেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে আস্তে আস্তে তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। যার ধারাবাহিকতায় তিনি ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নারায়নগঞ্জ-৪ আসন থেকে। কবরী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শুরু থেকেই জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘যেমন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, তেমনি করেই আমি ভিড়ে যাই স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রোধের সংগ্রামে। আমার ভাবতেই ভালো লাগে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা আর নির্বাচনে জিতে জাতীয় সংসদে সদস্য হয়েছি।’
কবরী ছিলেন একজন সমাজ সচেতন নাগরিক। চলচ্চিত্র শিল্পে যেমন, রাজনৈতিক চর্চায় ও ব্যক্তিগত জীবন যাপনেও সততা ও সাহসিকতার পরিচয় রেখে গেছেন। আপোষ করেননি। সংসার জীবনে দুইবার চরম আঘাত পেয়েছেন প্রথম স্বামী চিত্তরঞ্জন চৌধুরী ও দ্বিতীয় স্বামী শফিউদ্দিন সারোয়ারের কাছে। যথাক্রমে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে। তারপরেও দুই সংসারের (২+৩) পাঁচ পুত্রকে উচ্চ শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। সফল একজন সংসদ সদস্য হিসেবে, সচেতন রাজনীতিক, সংগঠক ও সমাজকর্মী হিসেবে সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে গেছেন। জীবন যুদ্ধ একাই করে গেছেন হার না মেনে।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশনে সফলতার সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন। সংশপ্তক (মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় অসমাপ্ত রয়ে যায়) ও মাটির কোলে ধারাবাহিক এবং রবীন্দ্রগল্প অবলম্বনে নাটক মালঞ্চ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। টেলিভিশনের জন্যে কিছু অনুষ্ঠানও নির্মাণ করেছেন। যার মধ্যে জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ছিল ধারাবাহিক-‘আমার নায়ক।’ জীবন্ত কিংবদন্তী বলি আমরা অনেকেই। করবী ছিলেন সত্যিকার অর্থেই তাই। একটা উদাহরণই যথেষ্ট। কখগঘঙ ছবির শুটিং হয়েছিল চুয়াডাঙা শহরে। ছবির চিত্রগ্রাহক ও প্রযোজক বেবী ইসলামের বাড়িতে। শুটিং শেষ হওয়ার পর চুয়াডাঙাবাসী সেই বাড়ির সামনের রাস্তার নামকরণ করেন ‘কবরী রোড’ যা আজও বহাল। ঘটনাটি ১৯৭০ সালের। কবরীর বয়স তখন ২০। এই বয়সেই তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এখনো এটা দ্বিতীয় রহিত উদাহরণ।
কবরীর আরেকটি গুণ লেখালেখি। তাঁর আত্মজীবনী ‘স্মৃতিটুকু থাক’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালের বইমেলায়। এই গ্রন্থে অকপটে তিনি অনেক কথাই বলেছেন বেশ সাহসের সঙ্গে। যুগান্তর পত্রিকায় বেশ কিছুদিন স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সামাজিক নানা বিষয়ে লেখালেখি করতেন। বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর প্রথম আলোতে ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর ‘আবরাবের জন্য’ শিরোনামে মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন কবরী। অভিনয়ের মতো লেখালেখিও ছিল তাঁর সাবলীল।
চট্টলকন্যা কবরীর জন্ম ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে। তবে শৈশব থেকেই বসবাস চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গিবাজারে। বাবা কৃষ্ণদাস পাল ও মা লাবন্যপ্রভা পাল ছিলেন সংস্কৃতি অনুরাগী। প্রথমে আলকরণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরে জেএমসেন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় চলচ্চিত্র যাত্রা। পরবর্তী সময়ে প্রাইভেটে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন চট্টগ্রামের প্রতি স্বভাবতই টান ছিল তাঁর। সময় পেলেই ফিরতেন নিজের শহরে। আত্মজীবনীতে ঘুরে ফিরে বারবার এসেছে এই শহরের কথা। জীবনী শেষ করেছেন ফিরিঙ্গিবাজারের কথা বলে, ‘রঞ্জন সেনের মাঠ। সবুজ ঘাস, ঘাসডুবো জল, একা।
কবরী নামের নদীটি বরাবরই ছিল স্রোতস্বিনী। কখনো উত্তুঙ্গ, কখনো নিস্তরঙ্গ তার ঢেউ। তবুও নিরবচ্ছিন্ন বয়ে গেছে মোহনার দিকে। বাধা পেলে জলপ্রবাতের মতো উচ্ছ্বসিত হয়েছে। কিন্তু বর্ণাঢ্য সেই নদীটির নিরবধি বয়ে চলা এভাবে থেমে যাওয়াটা কাম্য ছিল না কারোরই। সর্বনাশা কোভিড তাকে করুণভাবে থামিয়ে দিল ২০২১ এর ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বহু বর্ণিল এক অধ্যায়ের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটলো। তবে সত্যিকার অর্থে এই অধ্যায়ের কখনো পরিসমাপ্তি ঘটবে না।