কবরীর কিংবদন্তী হয়ে ওঠা

| রবিবার , ১৮ এপ্রিল, ২০২১ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

ষাটের দশকে দৃশ্যপটে আবির্ভাব, তারপর নানা রূপে, নানা ভূমিকায় তিনি ছিলেন জীবন্ত এক চলচ্চিত্র হয়ে। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চকে বিদায় জানালেন সারাহ বেগম কবরী। ১৯৬৪ সাল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত নির্মাণ করবেন ‘সুতরাং’ ছবিটি। এই ছবির জন্য চট্টগ্রাম থেকে আনলেন মিনা পাল নামের মাত্র ১৩ বছরের একটি কিশোরীকে। সুতরাং ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মিনা পালের ফিল্মি নাম হয়ে গেল কবরী। এ ছবির ‘পরানে দোলা দিলো এই কোন ভোমরা’ গানের মাধ্যমে কবরী দর্শক হৃদয়ে দাগ কাটেন। এ ছবি কিশোরী মিনা পালকে রাতারাতি অভিনেত্রী কবরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে সময়ে কোনো বাংলা ছবি হিসেবে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ ব্যাপক সম্মান পায়। মানে ‘সুতরাং’ দিয়েই বাংলাদেশি ছবির আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি শুরু। এরপর কবরীর শুধুই দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলা। একদিকে দক্ষ অভিনয় অন্যদিকে মনকাড়া হাসি দিয়ে সহজেই তিনি দর্শকমন হরণ করেন। তাই দর্শক তাঁকে ‘মিষ্টি মেয়ে কবরী’ আখ্যা দিতে ভোলেননি।
সে সময় উর্দু ছবির ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে আস্থাভাজন হয়ে উঠেন কবরী। জনপ্রিয় সিনেমা সাত ভাই চম্পা, অরুন বরুন কিরণমালা, নীল আকাশের নীচে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, আবির্ভাব, দর্পচূর্ণ, দীপ নিভে নাই, বিনিময়, আপন পর, কত যে মিনতি, ময়নামতি দিয়ে স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা চলচ্চিত্রে হয়ে উঠেন সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা। খ্যাতনামা পরিচালক জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’-তেও নায়িকা ছিলেন কবরী।
সমপ্রতি এক সাক্ষাৎকারে কবরী নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তখন আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। ক্লাস সিঙে পড়ি। সুভাষ দত্ত একটা কিশোরীর ভূমিকার জন্য খুঁজে আমাকে পেয়ে যান। সাংস্কৃতিক পরিবারে মানুষ হয়েছি। মা পুঁথি পড়তেন, ভাইবোনেরা নাচতেন-গাইতেন, ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। আমি নাচ করতাম। তবে আগে অভিনয় করিনি। যখন অফার পেলাম, তখন বাবা খুবই উৎসাহিত হলেন। মা দিতে চাননি। তিনি বললেন, ওর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবার একটু রক্ষণশীল তো ছিলই। আমার মায়ের ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনেকদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই তাঁর খুব শখ ছিল মেয়েকে পড়াবেন। আমি সুভাষ দত্ত, ফজলে লোহানী, খান আতা, জহির রায়হান থেকে অভিনয় শিখেছি।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমার নায়িকা হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান থেকে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী।
ফিরিঙ্গিবাজারে থাকাকালীন কবরী প্রথম ভর্তি হন আলকরণ স্কুলে। সেখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তাদের জে এম সেন হাইস্কুলে ভর্তি করা হয়। একদিন তাদের স্কুলে ‘ক্ষুধা’ নামে নাটক মঞ্চস্থ হবে বলে ঠিক হলো। কিন্তু যে ছেলেটির নাটকে অভিনয় করার কথা, সে আসেনি। অগত্যা কবরীকে তার জায়গায় অভিনয় করতে বলা হলো। এভাবেই তিনি প্রথম নাটকে অভিনয় করলেন। এর পরের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। কীভাবে তিনি মিনা পাল থেকে কবরী সারোয়ার হলেন, কীভাবে চলচ্চিত্রে আসলেন, হয়ে উঠলেন ঢাকাই সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’। অভিনয় সত্তাকে টিকিয়ে রেখে আবার তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে। এরপর তার পা পড়ল রাজনীতির মাঠেও। হলেন সংসদ সদস্য। অভিনয় জীবনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন কবরী। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও আজীবন সম্মাননার মতো বড় স্বীকৃতিও। কিন্তু সব ফেলে ৭০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ‘সারেং বউ’ খ্যাত এই অভিনেত্রী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজ্জাক-কবরী জুটিকে মানুষ কখনো ভুলবে না
পরবর্তী নিবন্ধকিউবার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ছাড়ছেন রাউল