‘কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল হামলাকারীরা’

বিটিভিতে তাণ্ডব

| বুধবার , ২৪ জুলাই, ২০২৪ at ৩:৪২ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সদর দপ্তরের নিচতলায় মিউজিয়াম। দেশের টেলিভিশন ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল সেখানে। সাজানোগোছানো কক্ষটি এখন চেনার কোনো উপায় নেই। পুরো কক্ষ এখনও ধ্বংসস্তূপ। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাচ, দেয়াল থেকে খসে পড়েছে ঐতিহাসিক সব ছবি।

ঘটনার পাঁচ দিনে কেটে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার হাতিরঝিলের রামপুরা ব্রিজ ও বিটিভিসংলগ্ন সড়কের ইউলুপের নিচের গেট দিয়ে বিটিভিতে প্রবেশ করতেই নাকে এল পোড়া গন্ধ। পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়ি, গাড়ি না বলে গাড়ির কঙ্কাল বলাই ভালো, যা আগুনে ভস্মীভূত।

ডান দিকে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের অভ্যর্থনা কক্ষ। দেখে বোঝার উপায় নেই কক্ষটি কয়েক দিন আগেও ছিল সাজানোগোছানো। সেখানে কেবলই পোড়া গন্ধ, আর যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে ধ্বংসের চিহ্ন। স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ছাড়া আর কখনোই বিটিভি এতটা আক্রান্ত হওয়ার তথ্য নেই। খবর বিডিনিউজের।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দফায় দফায় হামলা হয়েছে বিটিভির সদর দপ্তরে। গত ১৮ জুলাই দিনভর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণ কক্ষেরও দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছিল হামলাকারীরা। সহিংসতায় ঢাকার রামপুরায় বিটিভি কার্যালয়ের মুজিব কর্নার এবং ঢাকা কেন্দ্রের নিরাপত্তা গেট, অভ্যর্থনা কক্ষসহ অন্তত আটটি স্থানে আগুন দেওয়া হয়েছে। গত ১৮ জুলাই আন্দোলনের মধ্যে কয়েক দফায় চালানো হামলায় বিটিভিতে নেমে আসে বিভীষিকা, যার চিহ্ন এখন এর পুরো প্রাঙ্গণে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির দিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিন দফায় হামলার পর ৭টা ৪ মিনিটে সম্প্রচার বন্ধ এবং বিটিভি শাটডাউন করে স্টেশন ত্যাগ করেন কর্মকর্তাকর্মচারীরা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে চতুর্থ দফা হামলা হয়। হামলায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাটও চালানো হয়। এতে ২২ ঘণ্টা সম্প্রচার বন্ধ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এই টিভি স্টেশনটির।

বিটিভির কর্মকর্তাকর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চার দফা হামলা হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিটিভিতে প্রবেশ করতে পারেনি। রাত ১০টার দিকে বাহিনীর সদস্যরা বিটিভির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং রাত ১২টায় ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। তবে এর আগেই আগুনে পুড়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ, যন্ত্রপাতি, সম্প্রচারসামগ্রী ও গাড়ি।

গতকাল সরেজমিন বিটিভিতে দেখা যায়, ঢাকা কেন্দ্রের অভ্যর্থনা ও নিরাপত্তা কক্ষ, সামগ্রী রক্ষণাগার, ঢাকা কেন্দ্রের দ্বিতীয়তলায় ২৫টি কক্ষ এবং তৃতীয় তলার ১৬টি কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, হামলাকারীরা ১৭টি গাড়িতে আগুন দেয় এবং ৯টি গাড়িতে ভাঙচুর চালায়। ২ ও ৩ নম্বর গেট সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলেছে। সদর দপ্তরের প্রথম থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত লুটপাট ও ভাঙচুর চালায়।

বিটিভির মহাপরিচালক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এটি এখনই বলা সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়েছে। বিটিভি থেকেও আমরা একটি কমিটি করেছি। বিটিভি থেকে মামলাও করা হয়েছে। যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে। তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর বলা যাবে।

কী হয়েছিল সেদিন : কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির দিন (১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার) সকাল থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে উত্তপ্ত ছিল ঢাকার রামপুরাবাড্ডা এলাকা। বিটিভির কয়েকজন কর্মকর্তাকর্মচারী সেদিনের ঘটনা তুলে ধরেন। তারা বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিটিভি ভবন এলাকায় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়ার পর পুলিশের কিছু সদস্য বিটিভির গেট দিয়ে প্রবেশ করে অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে যান। পুলিশ সদস্যরা ভেতরে অবস্থান করছেন মনে করে বিটিভির গেটে এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে কিছু লোক। বেলা ১১টার দিকে বিটিভির ৪ নম্বর গেট ভেঙে হামলাকারীরা ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্থান ও কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। তবে প্রথম দফায় হামলাকারীরা সংখ্যায় কম থাকায় বিটিভির কর্মকর্তাকর্মচারীরা একজোট হয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন।

দ্বিতীয় দফা হামলা হয় বেলা ২টার দিকে। এ সময় হামলাকারী যারা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেক মধ্যবয়স্ক লোক ছিল জানিয়ে বিটিভির সহসম্পাদক মোহাম্মদ আজিম আনোয়ার বলেন, হামলাকারীদের মধ্যে শিশুরাও ছিল, দেখে মনে হয়েছে তারা পথশিশু। একটি ছোট মেয়েকেও দেখেছি হামলাকারীদের সঙ্গে। হামলাকারী সবাই ছাত্র ছিল না। নানা বয়সের লোক ছিল।

বিটিভির মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সকালে প্রথম দফা হামলায় ভাঙচুর করে, পরে ২টার দিকে এসে ভাঙচুরের পাশাপাশি গোডাউনে আগুন দেয়। এ সময় হামলাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ বলছিলেন, কন্ট্রোল রুম কোন দিকে? কন্ট্রোল রুমে ওরা ঢুকে পড়তে পারে, সেই শঙ্কা থেকে আমাদের কর্মীরা কন্ট্রোল রুমের দরজার সামনে পরিত্যক্ত আলমারি এবং কিছু আবর্জনা রেখে দেয়, যাতে ওরা কন্ট্রোল রুমের দরজা খুঁজে না পায়। কন্ট্রোল রুম দখল নিলে তো তারা যে কোনো ঘোষণা দেওয়ার জন্য আমাদের কর্মীদের বাধ্য করে ফেলত।

তাণ্ডবের সেই দিনে বিকাল ৬টার দিকে আবারও যখন হামলাকারীরা আসে, তখন বিটিভির মহাপরিচালক শাটডাউনের সিদ্ধান্ত নেন জানিয়ে বলেন, প্রথম হামলার পরপরই আমরা নিরাপত্তা বাহিনী এবং আমাদের বিভিন্ন দপ্তরসংস্থাকে অবহিত করেছি। ফায়ার সার্ভিসকে জানিয়েছি। কিন্তু তারা আসতে পারেনি। দুপুরের পর থেকে আমাদের কিছু কর্মী প্রাণের ভয়ে স্টেশন ত্যাগ করেন। আবার কিছু কর্মী আমার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। যখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল, পরিস্থিতি আমরা আর সামাল দিতে পারছিলাম না। তখন আমাদের কর্মীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই শাটডাউন করার। কারণ ৬টার দিকে যখন হামলকারীরা আসে, তারা ‘বিটিভি এখনও চলছে কেন?’ চিৎকার করে বলছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম, তারা কন্ট্রোল রুমের দিকে যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের কর্মীরা তখন পুরো বিটিভির লাইট নিভিয়ে দেয়, কন্ট্রোল রুম তালা দিয়ে দরজার সামনে আবর্জনার স্তূপ রেখে দেয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট ও বিজিবি সদস্যরা আসেন। তারা আমাকে বলেন, তারা আমাদের নিরাপদে বের করে নিয়ে যেতে এসেছেন। তখন আমরা বিটিভি থেকে বেরিয়ে যাই।

বিটিভির কর্মীরা স্টেশন ত্যাগ করার পরও হামলাকারীরা ফের ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর করে। তাদের আবার আগুন দিতে দেখেছেন বিটিভির একাধিক কর্মী। রাস্তা থেকে সেই দৃশ্য দেখেছেন তারা। তবে ৯টার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিটিভির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং বর্তমানে সেনা সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। ২২ ঘণ্টা সম্প্রচার বন্ধ : বিটিভির মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সম্প্রচার বন্ধের প্রক্রিয়া আমরা সাড়ে ৬টা থেকেই শুরু করি। ৭টা ৪ মিনিটে পুরোপুরি সম্প্রচার বন্ধ হয়। পরদিন সকাল ৮টা থেকে আমরা এসে দেখি যে কন্ট্রোল রুম অক্ষত আছে। আমরা বিকেল ৫টা থেকে সম্প্রচার শুরু করি। প্রথমে সম্প্রচারে কিছু ত্রুটি থেকে যায়, লোগো আসছিল না। পুরো সম্প্রচার শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায়। বলা যায়, পুরোপুরি সম্প্রচারে ফিরতে ২৪ ঘণ্টা লেগেছে। এখন কীভাবে লাইভ সম্প্রচার চলছে : সম্প্রচারে ফিরলেও নতুন অনুষ্ঠান নির্মাণের সক্ষমতা কমে গেছে জানিয়ে বিটিভির মহাপরিচালক বলেন, আমাদের একাধিক স্টুডিও তো ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আউটডোর অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যাবে, ইনডোরে কিছু অনুষ্ঠান করা যাবে। তবে নিজস্ব অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে গেলে আমাদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। এটি হয়ত সামনে কাজ করতে গেলে আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।হামলায় লাইভ সম্প্রচারের একটি অভিভ্যান পুড়িয়ে দেওয়া হলেও আরেকটি অভিভ্যান অক্ষত রয়েছে বলে বিটিভির কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হামলার দিন আমাদের একটি অভিভ্যান প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান লাইভ সম্প্রচারে ছিল। সদর দপ্তরে হামলা শুরু হলে সেটি তখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ছিল। সেই ভ্যানটি থেকেই এখন লাইভ সম্প্রচার চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধছবুরা খাতুন