এনবিআরের শাটডাউনের ফলে হাতছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ‘৩৩’। অর্থবছরের শেষ দিকে এসে দুই–তিন দিনের শাটডাউন সংক্রান্ত জটিলতা না হলে চট্টগ্রাম বন্দর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ৩৩ লাখ টিইইউসের বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করত। এখন বন্দর হ্যান্ডলিং করেছে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউস কন্টেনার; যা বন্দরের কন্টেনার পরিবহনের ৪৮ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ১৩ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৩ টন খোলা পণ্য এবং ৪ হাজার ৭৭টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে। এর আগে রেকর্ড ছিল ২০২১–২২ অর্থবছরের কন্টেনার হ্যান্ডলিং। ওই বছর ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টিইইউস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল।
সূত্র জানিয়েছে, মাত্র ৭ টিইইউস কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কন্টেনার হ্যান্ডলিংকারী পোর্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এরপর প্রতি বছর নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বিশ্বব্যাপী কন্টেনারে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরেও বেড়েছে কন্টেনার জাহাজের আনাগোনা, বেড়েছে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ। বিগত ৪৮ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দর কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের অবকাঠামোসহ প্রযুক্তিগত সুবিধায় সমৃদ্ধ হয়েছে। কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের ডেডিকেটেড জেটিসহ টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমানে তিনটি কন্টেনার টার্মিনাল রয়েছে। এছাড়া জেনারেল কার্গো বার্থের ছয়টি জেটিতেও কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের কার্যক্রম চলে। এই হিসেবে বন্দরের চারটি কন্টেনার টার্মিনাল রয়েছে। কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, স্ট্যাডল ক্যারিয়ারসহ কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি বন্দরের বহরে যুক্ত হয়েছে। কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বন্দর হিসেবে বিশ্বের শিপিং সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান পোক্ত। ইতোমধ্যে বিশ্বের কন্টেনার হ্যান্ডলিংকারী ১০০ শীর্ষ বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম। লয়েড’স লিস্টে আগামী বছর চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান আরো ভালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত সদ্যসমাপ্ত ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছে; যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৭ টিইইউস বেশি। কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ০২ শতাংশ।
কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দর বিগত ৪৮ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে বলে উল্লেখ করে বন্দরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, বছরব্যাপী নানা প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইনখ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। জুলাই আন্দোলন, দিনের পর দিন সাধারণ ছুটি, কারফিউ, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, দুই ঈদের ছুটি, কাস্টমসের কলম বিরতি, সাম্প্রতিক এনবিআরের শাটডাউন, পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বন্দরের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অন্তত ৬০ দিনের মতো ব্যাহত হয়। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ সকল বাধা–বিপত্তি কাটিয়ে বিগত অর্থবছরের তুলনায় অধিক সংখ্যক কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছে।
কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পাশাপাশি কার্গো হ্যান্ডলিংয়েও চট্টগ্রাম বন্দর তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৩ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৩ টন। আগের অর্থবছরে কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ টন। এক বছরের ব্যবধানে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে ৪ হাজার ৭৭টি। গত অর্থবছরে জাহাজ এসেছিল ৩ হাজার ৯৭১টি। প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। এ সাফল্যের মূলে রয়েছে সংকট উত্তরণে মাননীয় নৌপরিবহন উপদেষ্টার আন্তরিক দিকনির্দেশনা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ডের সদস্যবৃন্দের নিরলস তদারকি ও বন্দরের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।
তিনি বলেন, বন্দরের অটোমেশন সার্ভিস সুবিধা, ই–গেট পাস চালু, কন্টেনার অপারেটিং সিস্টেম আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নও এ সাফল্যের পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বন্দর ব্যবহারকারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, দ্রুত কন্টেনার ডেলিভারি নেওয়ার প্রবণতা, বন্দরের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করাসহ সার্বিক বিষয়ে সফলতা ছিল লক্ষণীয়। তবে অর্থবছরের শেষের ২–৩ দিন এনবিআরের শাটডাউন না থাকলে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা ৩.৩ মিলিয়ন ঘরে ঠেকত। সামনের দিনগুলোতে চট্টগ্রাম বন্দর নিশ্চয় আরো বেশি সাফল্য দেখাতে সক্ষম হবে।
গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সাফল্যের জন্য বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ যথা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, বন্দরের শ্রমিক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, অংশীজন বিশেষত আমদানি–রপ্তানিকারক, কাস্টম এজেন্টস এসোসিয়েশন, শিপিং এজেন্ট, বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, এফবিসিসিআই, সিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও পণ্য পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠনের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরের ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউস কন্টেনার ও ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫ টিইইউস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছিল। ২০২১–২০২২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। সেটিই ছিল এযাবতকালের সর্বোচ্চ কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে আগেকার সেই রেকর্ড ভঙ্গ করে বন্দর। তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয় ২০২৩–২৪ অর্থবছরে। ওই বছর ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল।