আন্তর্জাতিক কন্টেনার পরিবহনে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব কমছে। কন্টেনার পরিবহনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যাপকভাবে উন্নতি করলেও বাংলাদেশ কেবলই পিছিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) বহরে বছর কয়েক আগেও দুইটি কন্টেনার ভ্যাসেল থাকলেও এখন একটিও নেই। বেসরকারি এইচআরসি শিপিং লাইন্সের বহরে ছয়টি কন্টেনার ভ্যাসেল ছিল। এর একটিও এখন আর চলে না। দীর্ঘদিন কন্টেনার ভ্যাসেলহীন থাকা বাংলাদেশে বর্তমানে কেবলমাত্র ছয়টি কন্টেনার ভ্যাসেল রয়েছে। বেসরকারি কর্ণফুলী গ্রুপের মালিকানাধীন এই ছয়টি কন্টেনার ভ্যাসেলই দেশের পতাকা উড়াচ্ছে। বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও শুধুমাত্র উদ্যোগের অভাবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরে কন্টেনারে পণ্য পরিবহনের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখা এবং নিরাপত্তার কারণে এখন বহু খোলা পণ্যও কন্টেনারে ভরে পরিবহন করা হয়। চাল ডালের মতো পণ্যও আনা হচ্ছে কন্টেনারে। বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে মাত্র ৬ টিইইউএস কন্টেনার পরিবহনের মধ্যে দিয়ে এই যাত্রার সূচনা হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে ৩০ লাখ টিইইউএস এর বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। কন্টেনারে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কন্টেনার ভ্যাসেলের কদর বাড়ছে। পৃথিবীর শিপিং বাণিজ্যে নেতৃত্বদানকারী দেশগুলো তাদের বহরে প্রতিবছরই কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। কিন্তু ক্রমাগত কমছে বাংলাদেশের কন্টেনার জাহাজ। সরকারি বেসরকারি যথাযথ উদ্যোগের অভাবে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা কমছে বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের শিপিং বাণিজ্য কয়েক হাজার কোটি টাকার। বৈদেশিক মুদ্রার এই বিশাল বাজারের প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে দেশ থেকে। প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার ডলার বিদেশী জাহাজ মালিকদের দিয়ে দেশের আমদানিকারকদের পণ্য পরিবহন করতে হয়। অথচ দেশীয় শিপিং সেক্টরকে প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে দেশে ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন আইন কার্যকর রয়েছে। এই আইনে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ দিয়ে পণ্য পরিবহনের একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বহরে ২টি কন্টেনার ভ্যাসেল ছিল। চট্টগ্রাম-সিংগাপুর রুটে জাহাজগুলো চলাচল করতো। একই সাথে বেসরকারি শিপিং কোম্পানি এইচআরসির বহরে ছিল ৬টি কন্টেনার জাহাজ। এ সব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিংগাপুর এবং কলম্বো বন্দরে পণ্য কন্টেনার পরিবহন করতো। উপরোক্ত ৮টি জাহাজ দেশের শিপিং বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল। কিন্তু বিএসসি তাদের বহরে থাকা দুইটি কন্টেনার ভ্যাসেল স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেয়ায় এ সংখ্যা ছয়টিতে নেমে যায়। অথচ এই সময়ে কন্টেনার ভ্যাসেলের সংখ্যা ২০টি ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল বলেও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন পরবর্তীতে ছয়টি নতুন জাহাজ ক্রয় করলেও তাতে কোনো কন্টেনার ভ্যাসেল নেই। তিনটি অয়েল ট্যাংকার এবং তিনটি খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ক্রয় করে বিএসসি। বিএসসি এবং এইচআরসির কন্টেনার পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অংশীদারিত্ব ছিল না। অবশেষে বিগত ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে ‘এমভি সারেরা’ ও ‘এমভি সাহারে’ নামের দুটি পুরোনো কন্টেনার জাহাজ দিয়ে এই ব্যবসায় আসে ‘এইচআর লাইনস’। এরপর গত বছর প্রতিষ্ঠানটির বহরে যোগ হয় আরও ৪টি জাহাজ। সবমিলিয়ে বর্তমানে তাদের বহরে ৬টি কন্টেনার জাহাজ রয়েছে। এই ৬টি জাহাজ এখন প্রতি মাসে ১৭ হাজার কন্টেনার পরিবহন করছে। ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন আইন কার্যকর থাকায় জাহাজগুলো সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে জাহাজের সংখ্যা আরো বাড়লে দেশে বছরে গড়ে যেই তিন লাখ টিইইউএস কন্টেনার পরিবাহিত হয় তার একটি বড় অংশ এদের দখলে থাকতো বলেও সূত্র জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিপিং বিশেষজ্ঞ জানান, কন্টেনারে পণ্য পরিবহনের বাজারটি বিশাল। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ কন্টেনার পরিবহন বাণিজ্যের পেছনে চলে যাচ্ছে দেশ থেকে। বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো হলে এই টাকার একটি বড় অংশ দেশে রাখা সম্ভব হতো।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে ২২টি বিদেশী ফিডার অপারেটর প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ৮৪টি কন্টেনার ভ্যাসেল চলাচল করে। এ সব ফিডার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম থেকে পণ্য নিয়ে উপরোক্ত ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে মাদার ভ্যাসেলে তুলে দেয়, আবার ফিরতি পথে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা পণ্য ওই বন্দরগুলো থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসে।
পিওএমএমডি ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন বাংলাদেশের পতাকাবাহী ৬টি জাহাজ থাকার কথা স্বীকার করে বলেছেন, এর বাইরে আর কোনো কন্টেনার জাহাজ নেই। কন্টেনার পরিবহনের ব্যবসাটি বিশাল বলে উল্লেখ করে সাবেক পিওএমএমডি ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান বলেন, এটি একটি বিশাল বাজার। এর সম্ভাবনাও অনেক। তিনি সরকার কিংবা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এক্ষেত্রে বড় ধরনের পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন।