কথা রাখতে পারেনি ওয়াসা

বৃষ্টি না হওয়ায় হালদা ও কর্ণফুলীর উজানে লবণাক্ততা, উৎপাদন কমেছে দৈনিক ৮ কোটি লিটার ।। নগরীর কিছু এলাকায় বোতলের পানি কিনে প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ১৪ মার্চ, ২০২৪ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

কথা রাখতে পারে নি চট্টগ্রাম ওয়াসা। রোজার মধ্যে নগরীতে পানির কোনো সংকট হবে না বলে আশ্বস্ত করা হলেও প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে পানির সংকট। ওয়াসার পানি উৎপাদন দৈনিক প্রায় ৮ কোটি লিটার কমে যাওয়ায় নগরীর পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার চলছে। অপরদিকে বছরের পর বছর ধরে পতেঙ্গা এলাকার হাজার হাজার মানুষ ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বিভিন্ন সময় পানি সরবরাহের আশ্বাস দেয়া হলেও বিস্তৃত এলাকার অগুনতি মানুষ পানি পায়নি। এই রোজার দিনেও তারা পানি পাচ্ছে না, অনেকেই লবণাক্ত পানি দিয়েই ইফতার সেহেরি সারছেন। পতেঙ্গা এলাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে এর ৯২ শতাংশই আসে হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে। এরমধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প ১ থেকে ১৪ কোটি লিটার এবং শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প২ থেকে ১৪ কোটি লিটার মিলে এই দুইটি প্রকল্প থেকে মোট ২৮ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়। মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ওয়াসার সরবরাহে আসে ৯ কোটি লিটার পানি। এই প্রকল্পগুলো হালদা এবং কর্ণফুলী নদীর পানি নিয়ে পরিশোধন করে নগরীতে প্রেরণ করে। এর বাইরে ওয়াসার ৪০টির মতো ডিপ টিউবওয়েল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলন ও সরবরাহ দেয়া হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি, বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। পুরো নগরীর মানুষই মূলত চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির উপর নির্ভরশীল।

এক সময় রাতে দিনে পানির হাহাকার থাকলেও গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এখন আর নগরীতে পানির খুব বেশি হাহাকার চোখে পড়ে না। চট্টগ্রাম ওয়াসা একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পানি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক। এতে করে আগে যেখানে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে মানুষ ওয়াসার পানির জন্য অপেক্ষা করতো এখন সেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন রাতে দিনে পানি পাওয়া যায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চলমান রোজায় পানির কোনো সংকট হবে না এমন একটি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম ফজলুল্লাহ। তিনি রোজার প্রথম দিন থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার দেখা দেয়। ওয়াসার লাইনে কোনো পানি পাওয়া যাচ্ছে না বহু এলাকায়। কোনো কোনো এলাকায় এক দুই ঘন্টা পানি থাকলেও দিনের বেশির ভাগ সময় পানি জুটছে না।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বলেন, আসলে নগরবাসীর পানির চাহিদা পুরোপুরি মেটানোর সক্ষমতা ওয়াসার রয়েছে। কিন্তু ওয়াসার পানির প্রধান উৎস হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদীতে পানি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হচ্ছে। নদীর পানিতে তীব্র লবণাক্ততাও এক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে উঠেছে। সক্ষমতা থাকা স্বত্ত্বেও লবণের কারণে পানি উৎপাদন বন্ধ রাখায় সরবরাহ নেটওয়ার্ক থেকে দৈনিক ৮ কোটি লিটার পানি কমে গেছে। যা নগরীতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, কাপ্তাই হ্রদে বর্তমানে পানি রয়েছে ৮০ দশমিক ০৫ ফুট মিন সি (এমএসএল) লেভেল। এখন পানি থাকার কথা ৯০ ফুট এমএসএল। কাপ্তাই হ্রদের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ১০ ফুট কমে যাওয়ায় পানি ছাড়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। উপর থেকে পানি না আসায় কর্ণফুলীর লবণাক্ত পানি উজানেও লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপর থেকে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় নিচের জোয়ারের পানি বেশ উজানে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এর থেকে উত্তোরণ পাওয়ার জন্য কাপ্তাই হ্রদের পানি প্রবাহ বাড়াতে হবে। যা ভারী বৃষ্টি না হলে সম্ভব নয়। লবণাক্ততার কারণে জোয়ারের পর প্রায় ৮ ঘন্টা পানি উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয় মদুনাঘাটের শেখ রাসেল পানি শোধনাগারে। এই কেন্দ্রের পানি উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। মোহরা পানি শোধণাগার প্রকল্পের উৎপাদনও লবণাক্ততার কারণে ধস নেমেছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, হালদার পানিতে সর্বোচ্চ ২৬০০ মিলিগ্রাম লবণ পাওয়া গেছে। দ্রুত পানি কমছে হালদা নদীতে। পানির লেভেল মাইনাস ফিফটিন (-১৫) পর্যন্ত কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে মাইনাস ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ (-.) মাত্রা থাকার কথা। অপরদিকে কর্ণফুলীতে পানির লেভেল কমেছে থ্রি পয়েন্ট ফাইভ (-.) মাত্রায়।

পানির উৎপাদন এবং সরবরাহ কমে যাওয়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার বেড়েছে। বোতলজাত পানি দিয়ে প্রাত্যহিক কাজ কর্ম সারতে হচ্ছে মানুষকে। অনেকেই ওয়াসার বাউজারের জন্য চেষ্টা করেও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।

নগরীর কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন মাহমুদ জানান, রোজার শুরু থেকে পানির অভাবে আছি। কলে পানি নেই। বোতল কিনে প্রাত্যহিক প্রয়োজন সারতে হচ্ছে। ইফতার সে সেহেরিতে পানির হাহাকার মন খারাপ হয়ে যায় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

নগরীর খুলশী আবাসিক এলাকার চার নম্বর রোডের একটি ভবনের কেয়ারটেকার বদিউল আলম বলেন, তিনদিন ধরে পানি নেই। বড় কষ্টে আছি।

শুধু কাপাসগোলা বা খুলশীই নয়, নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ রোজার দিনে পানির কষ্টে থাকার কথা জানিয়েছেন। নগরীর হালিশহর এবং পতেঙ্গা অঞ্চলের পাশাপাশি কাট্টলী, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, দেওয়ান বাজার ও মুরাদপুর, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ পানির কষ্টে থাকার কথা জানিয়েছেন।

অপরদিকে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে উপকূলীয় এলাকা পতেঙ্গা অঞ্চলে। বিস্তৃত এলাকার অন্তত লাখ চারেক মানুষ বছরের পর বছর ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। কাঠগড় থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার মানুষ পানির ভয়াবহ রকমের কষ্টে আছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে যে, এলাকায় ওয়াসার লাইন থাকলেও পানি পাওয়া যায় না। আবার টিউবওয়েল বা ডিপ টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ততার জন্য মুখে দেয়া যায় না। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি খাওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন হাজার হাজার মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওয়াসার লাইন থাকলেও আমরা পানি পাই না। আমাদের এলাকায় ঘরে ঘরে ওয়াসার সংযোগ রয়েছে। আমরা নিয়মিত বিলও দিই। কিন্তু কোনোদিন এক ফোঁটা পানিও পাইনি। মোহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান নামের সমাজকর্মী নিজের বিলের কপি দেখিয়ে বলেন, গত বারো বছর ধরে বিল দিচ্ছি। কিন্তু লাইনে কোনোদিন ওয়াসার পানি দেখিনি।

সিমেন্ট ক্রসিংয়ের পর থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত পুরো এলাকাতে ওয়াহিদ হাসানের মতো হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন যারা বিল দেন, কিন্তু পানি পান না। বছরের পর বছর ধরে তারা এভাবে কষ্ট করে জীবনযাপন করছেন। শহরের ভিতরেও হলেও ওয়াসার পানি না পাওয়ার এই কষ্ট তাদেরকে শহরবাসী ভাবতে দিচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছেন সমাজকর্মী ওয়াহিদ হাসান। তিনি এলাকার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় তিন নাবিক পরিবারে উৎকণ্ঠা