পুরো চট্টগ্রাম নগর জুড়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতি। সড়ক কাটাকাটি ও ধুলোবালিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরবাসীর জীবনযাত্রা। যেখানেই আপনি যাবেন, দুর্ভোগ মাড়িয়ে, কষ্ট এড়িয়ে, হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে যেতে হচ্ছে আপনাকে। এমন দুঃসহ অবস্থার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে একটি সংবাদে। গত ১৭ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে ‘ধুলোয় ধূসর নগরী, মেগা প্রকল্পের চাপে বিবর্ণ ১২ সড়ক, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, নগরীতে বাস্তবায়নাধীন বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পের কারণে ধুলোয় ধূসর হয়ে পড়েছে নগরী। এতে কমপক্ষে ১২টি সড়কের ধুলোবালির কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন নগরবাসী। বিশেষ করে নগরীর অধিকাংশ এলাকায় সড়কের পাশে ফেলে রাখা ড্রেন নির্মাণ কাজে খোঁড়া কাদামাটি ও আবর্জনা থেকে সৃষ্ট ধুলোয় বিপর্যস্ত করছে নগরীকে। বাতাসে ধুলোর দূষণ বন্ধে নিয়মমাফিক পানি ছিটানোর কথা থাকলেও মানছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ধুলোবালির কারণে শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশনে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ধুলোবালির দূষণ মানবশরীরে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, মানমাত্রার বাইরে ধুলোর দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ কথা ভুললে চলবে না যে, নগর জীবন ও পরিবেশের গুণগত মান নির্ভর করে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও সেবা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত মাত্রার ওপর। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে পয়ঃনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, আবর্জনা পরিষ্কার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদি। কিন্তু দ্রুত নগরায়ণ ও নগরবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় এসব সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ায় নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি ও অব্যবস্থা বাড়ছে। এসবের ব্যবস্থাপনা যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা তাল সামলাতে পারছেন না।
এ কথা বলা জরুরি যে, ঢাকা শহরের পর চট্টগ্রাম ক্রমশ দূষিত নগরীতে পরিণত হচ্ছে। ধুলোয় ধূসর মারাত্মক বায়ুদূষণে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। কল-কারাখানাগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাস্তার ধুলোবালি। ফলে বাতাসে ধূলিকণাসহ বিষাক্ত সব পদার্থের উপস্থিতি প্রবল। নগরীর বাতাস ও পানি দূষিত হচ্ছে বলে নগরবাসী ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে। বেশিরভাগ নগরবাসী হয়তো জানেনই না যে তাঁরা নিজেরা ও তাঁদের নিষ্পাপ সন্তানেরা এই দূষিত বায়ুর কারণে এক ধীর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এই শহরে এমন কিছু উপাদান ও পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলোর সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় বাতাস অনবরত দূষিত হয়ে পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে। এর মধ্যে রয়েছে সংকীর্ণ রাস্তা, যানজট, ফুটপাত দখল, মোটরযানে নিম্নমানের অথবা মবিলমিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পুরনো মোটরযান, ঠাসাঠাসি যাত্রী পরিবহন, পুরনো লক্কর ঝক্কর গাড়ির মতো শিল্প কারখানা, ইটের ভাটা, খোলা জায়গায় কঠিন ও তরল বর্জ্য-আবর্জনা পড়ে থাকা, সেসবের পচন, আবর্জনা পোড়ানো ধোঁয়া ও গন্ধ, সময়মতো বর্জ্য অপসারণ না করা, অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং তা থেকে ধুলো ময়লার বিস্তৃতি, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ, খোলা পয়ঃপ্রণালী প্রভৃতি দূষিত বায়ুতে গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ও আমাদের অবোধ শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পানির লাইন, স্যুয়ারেজ প্রভৃতির মতো বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন ও সমপ্রসারণের প্রয়োজনে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। যখন যেখানে এ ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়, সেসব জায়গায় এমন একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যাতে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্ট ধুলোবালি, ময়লা, আবর্জনা কোথাও স্তূপ হয়ে না থাকে বা চারদিকে ছড়াতে না পারে। নগরবাসীর দৈনন্দিন যাতায়াতে যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় এবং এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। আমরা আর ধুলোয় মলিন হতে চাই না, বিষাক্ত বায়ু সেবন করে অসুস্থ হয়ে পড়তে চাই না। সুন্দর স্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে মুক্ত বায়ুতে আমরা নিঃশ্বাস ফেলতে চাই। আরও কঠোর হাতে এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একটি বাস্তবভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার চাইলেই নগরীর বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পরিবেশদূষণ কমিয়ে আনতে পারে। তার সঙ্গে চাই ব্যক্তিগত সচেতনতা।