দরিদ্র মানুষের ‘জীবন রঙিন করার স্বপ্ন’কে পুঁজি করে একটি চক্র চাকরির নামে করছে বেপরোয়া মানব পাচার। দালাল চক্র বিভিন্ন দেশে ভাল চাকরির কথা বলে তাদের সাথে প্রতারণা করে চলেছে। মানব পাচারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব। মানব পাচার রোধে মনিটরিং সেল গঠন করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দেশের মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা এবং অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধে এই সেলটি গঠন করেছে সিআইডি। মানব পাচারের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। এত কিছুর পরও মানব পাচারে জড়িত দালাল চক্র রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নির্ধারিত দেশে পৌঁছার পর অথবা আগেই অপহরণ করছে। অমানুষিক নির্যাতনের পর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আদায় করছে মোটা অংকের মুক্তিপণ। বছরের পর বছর ধরে এই পুরো জালিয়াতি সংগঠিত হচ্ছে দেশ ও দেশের বাইরে থাকা কয়েকটি মানব পাচার ও জিম্মি চক্রের মাধ্যমে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানব পাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার একাধিক নারী ও পুরুষকে আমরা দেশে ফিরিয়ে এনেছি। দেশি–বিদেশি চক্রের সহায়তায় বেশ কিছু গ্রুপ এ ধরনের মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। যারা বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখিয়ে অসচ্ছল নারী–পুরুষদের রাজি করায়। এসব চক্রের টার্গেট থাকে গ্রাম এলাকায়। তিনি আরও বলেন, যখনই আমরা মানব পাচারের মতো ঘটনা কিংবা মানব পাচারকে কেন্দ্র করে নির্যাতনের ঘটনার বিষয়গুলো অবহিত হই বা অভিযোগ আসে, তখনই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। এ ছাড়া মানুষকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
র্যাব ও সিআইডির তথ্য মতে– গ্রামের সহজ–সরল সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার ফাঁদটিতে রয়েছে পাঁচটি ধাপ। প্রতিটি ধাপেই রয়েছে মানব পাচার ও জিম্মি চক্রের সদস্যরা। চক্রগুলো প্রথম ধাপে স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে যেতে আগ্রহীদের সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় ধাপে জাল পাসপোর্ট–ভিসা প্রস্তুত করা হয়। তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ থেকে আকাশ বা নৌপথে বিদেশের পথে পাড়ি দেওয়া হয়। চতুর্থ ধাপে নির্ধারিত দেশে পৌঁছার পর কিংবা অন্য কোনও স্থানে নামিয়ে দিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের জিম্মি বা অপহরণ করা হয়। পঞ্চম ধাপে অপহৃতদের নির্যাতন করে সেই খবর স্বজনদের কাছে পৌঁছে বিনিময়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। চক্রটি মূলত অবৈধভাবে বিমান, স্থল ও নৌপথের মাধ্যমে ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, কানাডা, বলিভিয়া, মোজাম্বিক, নিউজিল্যান্ডে মানব পাচার করে।
উচ্চ বেতনে চাকরি, বছরে বোনাস, ভালোভাবে থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা–এসবের প্রলোভন দেখিয়ে বেকার যুবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব চক্র। এসব চক্রের সদস্যরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিষয়ে ভুক্তভোগীরাও কোনও অভিযোগ করতে চান না। এতে মানব পাচারের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তকারী সংস্থাকে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। যারা বিদেশ থেকে ফিরে আসেন, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ জন্য তারাও মুখ খুলতে চান না।
র্যাবের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, চলতি বছরের ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানব পাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌ–পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমারের কোস্টগার্ডের হাতে আটক হন। এ ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায় মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করে ভুক্তভোগী পরিবার। পরে মিয়ানমারে আটক যুবকদের পরিবারের সদস্যরা আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন করেন।
ইউএনওডিসির মানবপাচার নিয়ে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলার ৫১ শতাংশ মানুষ জীবিকার তাগিদে পাচারকারীদের ফাঁদে পা দেয়। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, নড়াইল, সিলেট, নওগাঁ, মাগুরা, যশোর, খুলনা, নরসিংদী, মাদারীপুর, কক্সবাজার, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনায় মানব পাচারকারী চক্রের তৎপরতা বেশি। চক্রের খপ্পরে পড়ে বিদেশ গিয়ে শেষে সর্বস্বান্ত হয়ে কেউ ফিরে আসে, কেউ নির্যাতন ভোগ করতে থাকে।