স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রায় ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। এটি দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম ও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। পেশাদার কূটনীতিক আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করেন। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়।
বাসস জানায়, এবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সুরক্ষা প্রদানে সামাজিক কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগির সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাজেটে। একইসঙ্গে বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ও কর কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর ফলে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে দাম কমবে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নিন্ম আয়ের মানুষকে সুরক্ষা প্রদান কার্যক্রম আরও সমপ্রসারণের কথা বলেছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী ।
বাংলানিউজ জানায়, অর্থনীতির কঠিন সময়ে দৃঢ় উদ্যোগের বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। উত্থাপিত বাজেটের লক্ষ্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট সামাল দেওয়া। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে আনা ও ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা সামাল দেওয়ার মতো কঠোর পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এ বাজেটে।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা আসবে ঋণ থেকে। প্রস্তাবিত বাজেটে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছ। মোট জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৬ সালে এলডিসি–উত্তরণ, ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের মর্যাদা এবং ২০৪১ সালে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার মতো লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক পথনকশা হিসেবে প্রণীত এ বাজেট বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য।
প্রস্তাবিত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। রাজস্ব আহরণে বরাবরের মতো এবারও বেশিরভাগ আয় করার দায়িত্ব থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের চেয়ে যা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। নন–এনবিআর খাত থেকে রাজস্ব আসবে আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যা আদায় হয়েছে, তাতে এনবিআর লক্ষ্য পূরণ থেকে অনেকটাই দূরে আছে। এর সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা বাড়নো হয়েছে। ফলে আগামী বাজেটের লক্ষ্য পূরণ রাজস্ব বোর্ডের জন্য অনেকটাই কঠিন হবে।
বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বিশাল ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি। এর মধ্যে প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাংক খাত। এই খাত থেকে মোট এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আর ৯৫ হাজার ১০০ টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়ার আশা করছে সরকার। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রীর সামনে অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, বিগত তিন বছরের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি থেকে ধীরে ধীরে বের হওয়া, সময়মতো সমাপ্তির উদ্দেশ্যে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলোয় অর্থায়নের জন্য কম–প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিদেশি অনুদানপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো ত্বরান্বিত করা এবং কাঠামোগত সংস্কার অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসা–বান্ধব পরিবেশের উন্নতি ঘটানো।
বিডিনিউজ জানায়, নানামুখী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যেও উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বড় ঘাটতির যে বাজেট নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রস্তাব করেছেন, তার ১৭ শতাংশের বেশি তাকে জোগাড় করতে হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হয়। তবে টাকা যোগানোর চাপ থাকায় ২০১৩–১৪ অর্থবছরের পর থেকে প্রতিবারই ঘাটতি ৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি ছিল। এবার সেই ধারায় যতি টানলেন অর্থমন্ত্রী।
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয় ঋণ করে। সরকার বিদেশি সাহায্য ও বিদেশি ঋণ নিয়ে, দেশের সরকারি–বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ধার করে, জনগণের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে। এবারের বাজেটের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হলে অর্থমন্ত্রীকে ওই অর্থের ৩৬ শতাংশের বেশিই জোগাড় করতে হবে ঋণ করে। সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মত ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন মাহমুদ আলী।
বিগত বছরগুলোতে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প করার তাগিদে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তবে বিদেশি ঋণের সুদ দিতে সরকারের রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করতে হয়। আর ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে ডলারের দর চড়ে যাওয়ায় এমনিতেই রিজার্ভ কিছুটা চাপে আছে। ডলারের সঞ্চয় ধরে রাখতে সরকার বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি কম জরুরি প্রকল্পে অর্থায়ন বিলম্বিত করার নীতি নেয় দুই বছর আগে। এবারের বাজেটে বিদেশের বদলে দেশের উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও ডলার বাঁচানোর কৌশলের দিকেই ইংগিত করছে। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে, যা মোট ব্যয়ের ১৭.২৫ শতাংশ।
এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন মাহমুদ আলী। ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে বাইরে থেকে আসা তারল্য যোগ হয়। তাতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ে। তাছাড়া সেই ঋণের জন্য সরকারকে সুদও গুনতে হয়। এবার দেশি–বিদেশি ঋণের জন্য ১ লাখ ১৩হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে অর্থমন্ত্রী হিসাব ধরেছেন, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে ঋণনির্ভর বাজেটের ধারা চলতে থাকায় দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হচ্ছে। ব্যাংক থেকে সরকার বেশি বেশি ঋণ নেওয়ায় তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার নাম এখন মূল্যস্ফীতি। ইতোমধ্যে এই হার দুই অংক ছুঁই ছুঁই। এ অবস্থায় সরকার বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যে ধরেছে, তা সংকট আরো বাড়াবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা। তিনি বলেন, ‘এই ঋণটা আমরা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিতে যাই, তাহলে সেটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিবে। সুতরাং এই দিকটায় লক্ষ্য রাখার দরকার ছিল।’