কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর সমুদ্র তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শহরের সাগর তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার অগভীর নলকূপ বিকল হয়ে গেছে। কিছু এলাকার গভীর-অগভীর নলকূপগুলো থেকেও ওঠে আসছে পানের অযোগ্য লবণাক্ত পানি। এনিয়ে পানি সংকটে পড়েছে শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে বসবাসকারী লক্ষাধিক বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার শহরে প্রায় ৩ হাজার গভীর নলকূপ ও ৩০ হাজার অগভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি তোলা হচ্ছে। শহরের ২ লাখ বাসিন্দা ছাড়াও প্রায় ১ লাখ পর্যটকের চাহিদা মেটায় এই নলকূপগুলো। উক্ত নলকূপগুলোতে বর্ষাকালে অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিক থেকে নভেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত স্বাভাবিক পানি থাকলেও বছরের বাকী সময় বিপত্তি ঘটে। এসময় পানীয় জলের সাথে উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত পানি ওঠে আসে অথবা নলকূপ বিকল হয়ে যায়। ইতোমধ্যে শহর ও শহরতলীর সাগর তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার অগভীর নলকূপ বিকল হয়ে গেছে। কিছু এলাকার গভীর-অগভীর নলকূপগুলো থেকে ওঠে আসছে পানের অযোগ্য লবণাক্ত পানি। বিশেষ করে শহরের ১নং ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেক সমিতিপাড়া, ২ নং ওয়ার্ডের ফকিরের কুয়া, উত্তর নূনিয়াছড়া, বিমানবন্দর সড়ক, ৩ নং ওয়ার্ডের এন্ডারসন রোড, ৪ নং ওয়ার্ডের পেশকারপাড়া, টেকপাড়া, হাঙ্গরপাড়া, ৫ নং ওয়ার্ডের আলীর জাঁহাল, এসএমপাড়া এবং ৬ নং ওয়ার্ডের বড়ুয়াপাড়া, মল্লিকপাড়া, সিকদারপাড়াসহ শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে গতমাসের (ডিসেম্বরের) শেষার্ধ থেকে এ সংকট দিনদিন তীব্র হয়ে উঠছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসআইএম আকতার কামাল জানান. পানির স্তর নীচের দিকে নেমে যাওয়ায় গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সমুদ্র তীরবর্তী এ এলাকার কয়েক হাজার নলকূপ বিকল হয়ে গেছে। নলকূপগুলো থেকে এখন পানের অযোগ্য অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ওঠে আসায় এলাকার দশ হাজারের বেশি মানুষ পানীয় জলের সংকটে পড়েছে। একই সংকট শহরের ২ নং ওয়ার্ডের একাংশেও দেখা দিয়েছে বলে জানান ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান।
পৌরসভার সংরক্ষিত ১, ২ ও ৩ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহানা আকতার পাখি বলেন, গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে লবণাক্ত পানি ওঠে আসায় খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েক হাজার বাসিন্দা পানি সংকটে পড়েছে।
১২ নং ওয়র্ডের ৫ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে কলাতলী পর্যটন এলাকায় প্রতি বছর মে মাসের শেষদিক থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়ে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পর্যটক বাড়ার সাথে সাথে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ: নীচে নামতে থাকে বলে জানান ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী মোর্শেদ আহমদ বাবু। এসময়েই কয়েক হাজার নলকূপ বিকল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন নলকূপ থেকে লবণাক্ত পানি ওঠে আসে। শহরের এই ওয়ার্ডেই রয়েছে প্রায় চারশত আবাসিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস ও কয়েকশত রেঁস্তোরা।
কক্সবাজার শহর ছাড়াও পাশ্ববর্তী ঝিলংজা, পিএমখালী ও খুরুশকুলের লক্ষাধিক বাসিন্দা পানীয় জলের সংকটে পড়েছে। শহরের মতোই এসব এলাকার নলকূপগুলো থেকে অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ওঠে আসছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। অথচ তীব্র খরা মৌসুম সত্ত্বেও গত এপ্রিলে কক্সবাজারের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ওপর দিকে ওঠে আসে।
শহরের সত্তরোর্ধ টিউবওয়েল মিস্ত্রি আবু জানান, ২ দশক আগেও শহরের বাহারছড়া থেকে কলাতলী পর্যন্ত এলাকায় মাত্র ১০ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে অগভীর নলকূপ আর ৩৫ থেকে ৪০ ফুটের মধ্যে গভীর নলকূপ বসানো হত। আর ৩৫-৪০ ফুটের গভীরতার নলকূপ থেকেই বছরের পর বছর ধরে ঝর্ণার মতই বেরিয়ে আসত সুপেয় পানি। আর সেটা স্বাধীনতার পরও ছিল মাত্র ২০-২৫ ফুটের মধ্যে। সেসময় বরাক বাঁশকে পাইপ বানিয়ে ঝর্ণার মত করে পানি তোলা হত।
পর্যটন শিল্পের বিকাশে গত তিন দশকে কক্সবাজারের ভূমির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন আসায় ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ সুস্বাদু পানির জলাধারে লবণাক্ত পানি মিশে যাচ্ছে বলে জানান কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী। তিনি বলেন, গত ৩ দশকে কক্সবাজারে ভূমির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পানীয় জলের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে, ভূ-গর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ত ও ইউরেনিয়াম-থোরিয়ামের মতো ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কক্সবাজার শহরে মিঠাপানির জলাশয় গড়ে তোলার এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি জানান, জরীপে শহরের কিছু অংশে সহনীয় মাত্রার ৫-৬ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও লবণাক্ততার উপস্থিতি ধরা পড়ে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।আবহাওয়া বিভাগ জানায়, কক্সবাজারে গত নভেম্বরে মাত্র ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরপর আর বৃষ্টির দেখা নেই।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ১৫০ কোটি মানুষ তীব্র পানি সংকট কিংবা খরার মধ্যে বাস করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির চাহিদা বৃদ্ধি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাপী কৃষিখাতকে সমস্যার মুখে ফেলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক কু ডংইউ বলেন, সুপেয় পানি সরবরাহ ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা এবং অপর্যাপ্ত বৃষ্টির প্রতিচ্ছবি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, কক্সবাজার শহরবাসীর ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটাতে বাঁকখালীর নদীর পানি ব্যবহারে একটি পানি শোধনাগার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি চালু হলে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমবে।