কক্সবাজার উপকূলে এবার বিষধর জেলিফিশ শনাক্ত

রয়েছে ঔষধি গুণ

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | সোমবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার উপকূলে প্রথমবারের মতো একটি বিষধর প্রজাতির জেলিফিশ শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। কয়েকদিন আগে পেঁচারদ্বীপ উপকূলে জেলেদের জালে আটকা পড়া ২টি জেলিফিশ উদ্ধারের পর প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে সেগুলো ঘোস্ট জেলিফিশ বা সায়ানিয়া নোজাকি প্রজাতির বিষধর জেলিফিশ হিসাবে শনাক্ত করেন। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘গরু নুইন্না’ ও ‘হাতি নুইন্না’ নামে পরিচিত।

তবে এই জেলিফিশটি হালকা বিষধর হলেও এর শরীরে মূল্যবান ঔষধি গুণ রয়েছে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌমিত্র চৌধুরী। তিনি জানান, ঘোস্ট জেলিফিশ বা সায়ানিয়া নোজাকি প্রজাতির জেলিফিশ থেকে কোলাজেন পেপটাইড তৈরি করা হয়। কোলাজেন পেপটাইড ওষুধ, স্বাস্থ্য পণ্য এবং ত্বকের যত্নের প্রসাধনী তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।

তিনি জানান, এটি সাধারণত জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর এবং ইয়েলো সাগরের মতো অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে এই প্রজাতিটি ভারতের উপকূলেও দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালে কেরালা উপকূলে ব্লমের তথ্য পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই প্রজাতিটি পরিলক্ষিত হয়েছে। এটি ব্লুম কিনা তা নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন।

সৌমিত্র চৌধুরী জানান, এই প্রজাতিটিতে বিষাক্ত নেমাটোসিস্ট থাকায় এটি মানুষের জন্য হালকা ঝুঁকিপূর্ণ। এর সংস্পর্শে ত্বকে জ্বালাপোড়া এবং হূল ফোটানোর মাধ্যমে বেদনাদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে মানুষভেদে এর দংশনের তীব্রতা পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু কিছু মানুষ যারা অ্যালার্জিক তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান ফুলে যেতে পারে। যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে তাদের সিস্টেমিক প্রতিক্রিয়াসহ গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

স্থানীয় জেলেদের মতে, গরু নুইন্না ও হাতি নুইন্না নামে পরিচিত এই জেলিফিশটি দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার উপকূলে ধরা পড়ছে। এটি তেমন বিষধর নয়। বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে বিষধর জেলিফিশ হলো অইনা নুইন্না বা অগ্নি জেলিফিশ। যেটির টেনটাকলের সংস্পর্শে এলে ক্ষতস্থানে পচন ধরে এবং শরীরে খুব জ্বালাযন্ত্রণা করে। তবে ক্ষতস্থানে সাথে সাথে সাগরলতা বা ডাউঙ্গা লতার কষ ব্যবহার করলে ব্যথা ও যন্ত্রণা প্রশমিত হয়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে সচরাচর সাগরলতা দেখা যায়।

জেলেরা জানান, সাগরের বিষধর জেলিফিশগুলো চান্দা মাছের প্রিয় খাদ্য। যেখানে জেলিফিশ বেশি দেখা যায়, সেখানে চান্দা জাতীয় মাছও বেশি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদা রশিদ বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির জেলিফিশ খাওয়ার উপযোগী। বঙ্গোপসাগরেও অন্তত ৩ প্রজাতির খাওয়ার উপযোগী জেলিফিশ পাওয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য প্রজাতির জেলিফিশগুলোতেও রয়েছে মূল্যবান ঔষধি গুণ।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি জেলিফিশের দাম ১০ ডলার বা প্রায় ১১শ টাকা। বিশ্বে জেলিফিশের প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। সেই জেলিফিশ এখন কক্সবাজার সৈকতের পোকামাকড়ের খাদ্য।

প্রফেসর ড. তৌহিদা রশিদ বলেন, শত শত বছর ধরে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসছে মরা জেলিফিশ। একসময় এই মরা জেলিফিশ বা নুইন্না জমা হতো শহরের উত্তরাংশে বাঁকখালী নদী ও সমুদ্র মোহনার চরে। ‘নুইন্না’ থেকেই শহরের বিমানবন্দর সংলগ্ন ২ নং ওয়ার্ডের নামকরণ হয়েছে নুনিয়ারছড়া, যা স্থানীয়ভাবে নুইন্নাছরা নামে পরিচিতি পেয়েছে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেলিফিশ থেকে তৈরি হচ্ছে সার, কীটনাশক, ওষুধ ও কসমেটিক্সসহ নানা পণ্য। এশিয়ার কিছু অঞ্চলে, জেলিফিশ হাড় ও পেশির ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। জেলিফিশ রপ্তানি করে বাংলাদেশও প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। সুনীল অর্থনীতিতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তারই লক্ষ্যে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জেলিফিশ নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আগামীতে এ বিষয়ে বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করা হবে।

বিজ্ঞানীরা জানান, জাপানিরা জেলিফিশকে ক্যান্ডিতে রূপান্তরিত করেছে। এক ধরনের মিষ্টি ও নোনতা ক্যারামেল, চিনি, স্টার্চ সিরাপ এবং জেলিফিশ পাউডার দিয়ে তৈরি করা হয় সেই ক্যান্ডি, যা ব্যয়বহুল এবং সুস্বাদু। এছাড়া সালাদ, নুডলস এবং সয়া সস দিয়ে খাওয়া হয়। থাইল্যান্ড জেলিফিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এছাড়া কোলাজেনের উৎস হিসেবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, ঔষধ শিল্পে এবং বিশ্বজুড়ে পাবলিক একুরিয়ামে জেলিফিশ প্রদর্শিত হয়।

সামুদ্রিক পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানান, প্রায়শ সমুদ্র বিজ্ঞানীরা জেলিফিশ এবং অন্যান্য জীবের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখার মাধ্যমে সমুদ্রের স্বাস্থ্য নিরীক্ষা করেন। এছাড়া কার্বন ক্যাপচারে এবং গভীর সমুদ্রে মাছের বিকাশের জন্য মাইক্রোহ্যাবিটেট তৈরিতেও জেলিফিশের অবদান রয়েছে। এদের যথেষ্ট অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা হুমকিস্বরূপ। তবে জেলিফিশের কিছু কিছু প্রজাতি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে মানুষের খাদ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। চীন, জাপান ও কোরিয়ার মতো বেশ কিছু জায়গায় এটি খুব মজার খাবার হিসেবে বিবেচিত।

তবে নামে ফিশ হলেও জেলিফিশ আসলে মাছ নয়। এদের বাহ্যিক গঠনের সাথে মাছের গঠনের মিল নেই। এরা মূলত নিডারিয়া পর্বের অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা এতই বৈচিত্র্যময় যে, অনেক বিজ্ঞানী তাদের কেবল জেলাটিনাস জুয়োপ্ল্যাংকটন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জেলিফিশের মাছের মতো আঁশ, ফুলকা বা পাখনা থাকে না। এর পরিবর্তে তারা তাদের গোলাকৃতি ‘বেল’ খোলা এবং বন্ধ করার মাধ্যমে সাঁতার কাটে। তাদের শরীর ৯৮ ভাগ পানি দিয়ে গঠিত। যখন তারা উপকূলে ভেসে চলে আসে, কয়েক ঘণ্টা পরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। কারণ তাদের দেহ দ্রুত বাতাসে বাষ্প হয়ে যায়। তাদের কোনো মস্তিষ্ক নেই, কেবল একটি প্রাথমিক স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা জানান, জেলিফিশ সমুদ্রের নিচের খাদ্য শৃক্সখলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যদিও এরা অপেক্ষাকৃত ছোট ও সহজ প্রাণী। এরা সমুদ্রের সূক্ষ্ন বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এরা এক ধরনের প্লাংকটন বলে গভীর সমুদ্রের কচ্ছপ, সানফিশ, স্পেডফিশ, টুনা, হাঙর, কাঁকড়া এবং বিভিন্ন ক্রাস্টাশিয়ানের প্রিয় খাদ্য। অন্যদিকে সামুদ্রিক শৈবাল, জুয়োপ্লাংকটন এবং ছোট ছোট চিংড়ি জেলিফিশের প্রিয় খাদ্য। এভাবে এসব সামুদ্রিক প্রাণীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জেলিফিশ একটি স্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। মানুষের চেয়েও আদিম এই প্রাণীটির পৃথিবীতে আগমন প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটানা ৯ জয়ে ফাইনালের অপেক্ষায় ভারত
পরবর্তী নিবন্ধ১০ দিনে প্রবাসী আয় ৮,৭৭৮ কোটি টাকা