কক্সবাজার উপকূলের মাছে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত প্লাস্টিক পাওয়া যায়নি। গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বুরি) বিজ্ঞানীরা কক্সবাজার উপকূলের মাছের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করলেও উদ্বেগজনক কিছু দেখতে পাননি। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন সাগরের মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যা মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের পেঁচারদ্বীপস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সুনীল অর্থনীতি নিয়ে ২০২১–২২ অর্থবছরে সম্পাদিত গবেষণা ফলাফল উপস্থাপনের উপর আয়োজিত এক সেমিনারে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য প্রকাশ করেন। সেমিনারে ‘সুনীল অর্থনীতি ও বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট বিজ্ঞানীদের গবেষণা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। সেমিনারে প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন যথাক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) অধ্যাপক ড. মো. কাউসার আহাম্মদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. রাশেদউন্নবী রাফি। সেমিনারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্ধশতাধিক বিজ্ঞানী ছাড়াও মিডিয়াকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির বার্ষিক অবদান ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের ৪ শত ৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ খনিজ গ্যাস ও তেল সরবরাহ করা হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন তেল–গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা যখন প্রায় ৯শ কোটি হবে তখন এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মানুষকে সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হবে। সেই লক্ষে জাতিসংঘও ২০১৫ সাল পরবর্তী যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছে তার মূলে রয়েছে সুনীল অর্থনীতি। আর সুনীল অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে টেকসই সমুদ্র নীতিমালা।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বলেন, স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় দেশের পূর্ব উপকূল সংলগ্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত প্রায় ৮০০০ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার খনিজ সম্পদ এবং ভূ–তাত্ত্বিক, ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব উপাদানসমূহ চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। এছাড়া সামুদ্রিক শৈবাল (সি–উইড) ও প্রবালের টেক্সোনমিক বৈশিষ্ট চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত পুস্তক প্রকাশের কাজ চলছে। আর মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কক্সবাজারে মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্র উপকূলের তৈল নিঃসরণ, মেরিন অ্যাকুয়াকালচার (মেরিকালচার), কাঁকড়া ও ঝিনুক ইত্যাদির খাদ্যগুণ পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় গভীর সমুদ্রের খনিজ চিহ্নিতকরণ ও গবেষণা কাজ করা হবে।
তিনি জানান, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে ৫ বছর মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে ফেনী পর্যন্ত সমুদ্র এলাকার খনিজ চিহ্নিতকরণ, অপ্রচলিত সামুদ্রিক প্রাণী চাষাবাদ, সামুদ্রিক এসিডিফিকেশন পরীক্ষা, সামুদ্রিক ক্ষুদ্র জীব (ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটন) চিহ্নিতিকরণ, সামুদ্রিক শৈবাল (সি–উইড) চিহ্নিতকরণ, উপকূলীয় জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনার ৭৫% ভাগ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি ২৫% ভাগ কার্যক্রম ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে।
মহাপরিচালক জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট (এমএইউ) কর্তৃক প্রণীত সুনীল অর্থনীতি উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সামুদ্রিক মৎস্যচাষ (মেরিকালচার), সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন, ডলফিন ও তিমি দর্শন ও তাদের আবাসস্থানসমূহ চিহ্নিতকরণ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল রক্ষা করা, সমুদ্র ভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং সামুদ্রিক সম্পদ থেকে কসমেটিক্স উৎপাদন ইত্যাদি রয়েছে।
তিনি বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামুদ্রিক শৈবাল থেকে ইতোমধ্যে এগার, ক্যারাজিনান ও এলজিনেট উৎপাদন করা হয়েছে, যা এ ধরনের শিল্প স্থাপন ও কসমেটিক্স উৎপাদনের লক্ষ্যে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া সামুদ্রিক মৎসচাষ (মেরিকালচার) এর জন্য উপযুক্ত এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত কাজ চলছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল রক্ষার জন্য প্রবাল চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রবাল প্রাচীর পুনরুদ্ধারের জন্য গবেষণা কাজ চলছে।