কক্সবাজার উপকূলেও তিমির বিচরণ ও আবাস!

কক্সবাজার প্রতিনিধি | রবিবার , ৯ মে, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

শুধু ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ নয়, বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলেও তিমির বিচরণ ও বাসস্থান রয়েছে; যে কারণে কক্সবাজার উপকূলে বারবার তিমির মৃতদেহ ভেসে আসছে। বিজ্ঞানীদের মতে, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকূল থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে বিচরণ রয়েছে বিশ্বের বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির কয়েক প্রজাতির তিমির। সাগরের গভীরতম স্থান হওয়ায় এখানে তাদের বাসস্থানও থাকতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বিশ্বের বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বেশ কয়েকটি তিমিসহ প্রায় এক ডজন স্তন্যপায়ী প্রাণীর হটস্পট বা আবাসস্থল হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পর সরকার ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের ১,৭৩৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল বা মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষণা করে। বাংলাদেশের সুন্দরবনের ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে ১ কিলোমিটারের বেশি গভীরতা সম্পন্ন একটি সমুদ্র তলদেশীয় আন্তর্জাতিক খাদ, যা ভারতীয় অংশে ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং বাংলাদেশ উপকূলে খাদের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র ৬ কিলোমিটার প্রশস্ত হয়ে এর সমাপ্তি ঘটেছে। এই খাদটিই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড নামে পরিচিত।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) সর্বশেষ জরিপ মতে, বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে একটি নদীতে থাকে, বাকি ১১টি থাকে সাগরে। বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এদের হটস্পট হলেও আশেপাশের সাগরেও তাদের বিচরণ দেখা যায় বলে জানান ডব্লিউসিএসের বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন।
তিনি বলেন, কক্সবাজার উপকূল থেকে মাত্র দেড়শ থেকে ২শ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। সেখানে ইতোমধ্যে ৪ প্রজাতির তিমি ছাড়াও ৭ প্রজাতির শুশুক (ডলফিন) ও এক প্রজাতির পরপইসের আবাসস্থল শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে থাকা চার প্রজাতির তিমির মধ্যে ব্রাইড’স বা বলিন তিমি, গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি, ঘাতক তিমি বা চিতা তিমি এবং ছদ্ম ঘাতক বা নকল চিতা তিমি অন্যতম। কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকূল থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে বিচরণ রয়েছে তিমি ও ডলফিনসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর।
তবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনভারসেশন অব নেচার (্‌আইইউসিএন) বাংলাদেশের ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ৩ প্রজাতির তিমি রয়েছে। এগুলো হলো ব্রাইডিস, ফল্‌স কিলার ও শুক্রাণু তিমি।
বাংলাপিডিয়ার বাংলাদেশের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাইটে একেএম আমিনুল হক (২০১৪) সম্পাদিত তথ্য অনুযায়ী, ১৮৪২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম উপকূলের কাছে একটি তিমি আটকে পড়েছিল, যেটি বলিন তিমি বলে শনাক্ত হয়েছিল।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, ডব্লিউসিএসের ২০১৭ ও ২০১৮ সালের জরিপকালে গবেষকরা সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে ব্রাইড’স হুয়েলের মা ও শাবক তিমিকে একসাথে দেখেছেন।
কঙবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরে তিমির আবাস ও বিচরণ রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পিএইচডি ফেলো মোহাম্মদ আশরাফুল হক। তিনি বলেন, কঙবাজার উপকূলে বারবার জীবিত ও মৃত তিমি ভেসে আসার ঘটনায় প্রমাণিত হয় কঙবাজার উপকূলের আশেপাশে তিমির বিচরণ ও আবাস রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমি কঙবাজার শহরের ফিশারিঘাটস্থ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে প্রায় ১৮ ফুট লম্বা মৃত একটি স্পার্ম হুয়েল দেখি, যেটি টেকনাফ সংলগ্ন সমুদ্র থেকে পার্চসিন জালে জীবিত ধরা পড়েছিল বলে জেলেরা আমাকে জানিয়েছিলেন। এছাড়া কঙবাজারে বিভিন্ন উপকূলে বিভিন্ন সময়ে তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৮৬, ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে লাবণী পয়েন্টে মৃত তিমি ভেসে আসে। ২০২০ সালে আসে শাহপরীর দ্বীপের বাংলা চ্যানেলে এবং সর্বশেষ এপ্রিলের ৯ ও ১০ তারিখে হিমছড়িতে দুটি মৃত তিমি ভেসে আসে। এসব ঘটনা কঙবাজার উপকূলের গভীরতম সমুদ্রে তিমির আবাসস্থল থাকার সম্ভাবনা প্রমাণ করে।
বিজ্ঞানীরা জানান, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রিভার সিস্টেম গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বা পদ্মা-যমুনা-মেঘনা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপুল পরিমাণ স্বাদু পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। যার ফলে বাংলাদেশের উপকূল ও সাগরের পানি পৃথিবীর অন্যতম উর্বর জলরাশি হিসাবে স্বীকৃত। এখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যসহ বিশ্বে বিপন্নপ্রায় বিরল কয়েকটি সামুদ্রিক জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল (হটস্পট)। এর মধ্যে রয়েছে মহাসাগরীয় জায়ান্ট হিসাবে পরিচিত কয়েক প্রজাতির তিমি ও ডলফিন। পৃথিবীর মোট ৬৪টি লার্জ মেরিন ইকোসিস্টেম বা সমুদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বঙ্গোপসাগরও অন্যতম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাস্ক না পরায় রোদে দাঁড় করিয়ে শাস্তি
পরবর্তী নিবন্ধঈদবাজারে বাড়ছে চাপ