বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজার। পর্যটন ঘিরে পৌর শহরে বিস্তৃত হচ্ছে নগরায়ন। এতে বাড়ছে জনসংখ্যা। বহুমুখী চাপে বেড়েছে সুপেয় পানির চাহিদাও। তবে গত এক দশক ধরে এ জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিম্নমুখী। এর ফরে সমুদ্রপাড়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র গরম, তার উপর অনেকটা ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। শুধু পৌর শহর নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, কক্সবাজার শহর এবং উপজেলাগুলোতে প্রতি বছর গড়ে ১০–১৫ ফুট ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে যাচ্ছে। আগে ১২০–১৫০ ফুটে ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যেত। এখন তা ৩০০ ফুটের গভীরে নেমেছে। নলকূপ দিয়ে উঠছে লবণ পানি। এই ধারাবাহিকতা থাকলে আগামীতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জনশুমারি ও গৃহ গণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার জেলার ৯৭.৬৪ শতাংশ মানুষের পানির উৎস গভীর–অগভীর নলকূপ। এর বাইরে ০.৬১ শতাংশ সরবরাহকৃত, ০.৭৯ শতাংশ বোতলজাত, ০.৬৩ শতাংশ ভালপানি এবং ০.১৪ শতাংশ পুকুর, খাল, নদী ও লেকের পানি পান করেন।
যে কারণে নেমে যাচ্ছে স্তর : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম সম্প্রতি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কম হওয়া, তাপমাত্রা অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি, পুকুর, খাল–বিল, জলাশয় ভরাট করে হোটেল–মোটেল, আবাসিক ভবন ও রাস্তাঘাট তৈরির কারণে জলাশয় কমে যাওয়া, শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বৃক্ষ নিধনের কারণে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত কমছে।
অধ্যাপক শফীকুল বলেন, পানির স্তর নিচে গেলে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। এতে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝোঁকও বাড়ে। পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায়, এতে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়।
বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে কক্সবাজার জেলায় ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক ধ্বংস বন করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, কক্সবাজার অঞ্চলে বৃক্ষনিধন ও পাহাড় কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণকালে কৃষিজমি, নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। তার আশঙ্কা, প্রাকৃতিক পরিবেশ সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার না করলে আগামীতে এই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় নামবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজার পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে উত্তর নুনিয়ারছড়া। এলাকাটির উত্তরে মহেশখালী চ্যানেল। পূর্বে বাঁকখালী নদী। অবস্থান একেবারে নদীর লাগোয়া। কিন্তু চারপাশে পানি থাকলেও এখানকার বাসিন্দাদের খাবার পানির দুঃখ যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, দুই কিলোমিটার দূরের মসজিদের নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন।
গত মঙ্গলবার বিকালে গৃহিণী জমিলা বেগম বলেন, ৩ বছর ধরে পানির সমস্যা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছি। নলকূপ দিয়ে যে পানি ওঠে তা লবণাক্ত। কিন্তু কোনো উপায় নেই। পানির কারণ শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছি।
আবদুর রহমানের (৭৪) ভাষ্য, বছর দশেক আগে ওই এলাকায় মিঠাপানি পাওয়া যেত। তবে সম্প্রতি ৭০০ ফুট গভীরে গিয়েও পানি পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, এখন যেটা পাচ্ছি এটা প্রথম স্তরের পানি। এটার গভীরতা ১০–১৫ ফুট, এই পানি দূষিত।
তাদের সঙ্গে আলাপকালে এগিয়ে এলেন গৃহিষী আনজুমান আরা, শাহিদা বেগম, রুনা লায়লা েরাশেদা বেগম। আনজুমান বলেন, এখানকার ৩০ পরিবারের সদস্যরা দুই কিলোমিটার দূরের মসজিদের গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করে।
রাশেদা বেগমের ভাষ্য, পানির কারণে গোসল, রান্নাবান্না, কাপড়–চোপড়, আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানান ধরনের চর্মরোগ। ১০–১২ বছর ধরে এই অবস্থা চলছে।
শুধু পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড নয়, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকার চিত্র একই। কোথাও কোথাও পানি কিনে খেতে হচ্ছে।
পৌরসভার ৩ কূপ বন্ধ : কক্সবাজার পৌরবাসীর জন্য দৈনিক কী পরিমাণ সুপেয় পানির প্রয়োজন সেই পরিসংখ্যান কোনো দপ্তর কিংবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কাছে নেই। তবে এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের প্রায় ৩ হাজার গভীর নলকূপ ও ৩০ হাজার অগভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক ৩ কোটি লিটার পানি তোলা হয়। এই পানি ২ লাখ বাসিন্দা এবং ১ লাখ পর্যটকের চাহিদা মেটায়।
কক্সবাজার পৌরসভার তথ্যমতে, পৌরসভার অধীনে ১০টি কূপ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার গ্যালন পানি উত্তোলন করা হতো। কিন্তু ৩–৪ বছর ধরে পানি উত্তোলন নেমেছে ৩৫–৪০ হাজার গ্যালনে। উত্তোলন করা পানিগুলো ১ হাজার ৪০টি পরিবারকে সরবরাহ করা হয়।
পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১০টি কূপের মধ্যে ৩–৪টি কূপের পানি ভালো পাওয়া গেলেও ভূগর্ভে পানি না থাকায় বাকিগুলো বন্ধ রয়েছে। ৭–৮ বছর ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে চলমান এই সমস্যার কারণে শহরের বাসিন্দা ও মোটেল–মোটেলে পানির চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, এডিবির অর্থায়নে নির্মিত সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি শিগগিরই চালু হবে। এটি চালু হলে প্রতি ঘণ্টায় ১০ লক্ষ লিটার করে দৈনিক ৮ ঘণ্টায় ৮০ লক্ষ লিটার সুপেয় পানি পাওয়া যাবে। এতে সুপেয় পানির সংকট কেটে যাবে।
কুতুবদিয়া–মহেশখালীতে উপকূলে লবণাক্ততা : কুতুবদিয়া সুপেয় পানির সংকটে ধুঁকছে। অকেজো হয়ে পড়েছে অগভীর নলকূপ। উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং এবং লেমশীখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ১০–২০টি পরিবার মিলে একটি নলকূপ থাকলেও অনেক এলাকায় নলকূপ নেই। অপরদিকে মহেশখালী পৌরসভা, কুতুবজোম, মাতারবাড়ি, ধলঘাটায় লবণাক্ততার পরিমাণ ভয়াবহ আকারে ধারণ করেছে।
কুতুবদিয়ার স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কুতুবদিয়ার আহ্বায়ক এম শহীদুল ইসলাম বলেন, দ্বীপে কিছু এলাকায় ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট নিচে সুপেয় পানির স্তর, কোথাও আবার ১২শ ফুট গভীরে নলকূপের পাইপ বসাতে হচ্ছে। বিশেষ করে, বৃহৎ পাইলটকাটা খাল ভরাট, দখল–দূষণে নাব্যতা না থাকায় বিগত ৩–৪ বছর যাবৎ লবণ চাষিরা পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ লবণ পানি উত্তোলন করে লবণ চাষ করছেন।
তিনি বলেন, কৃষকেরা গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে ধান ও লবণ চাষ করছে। এ কারণে সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে।
করণীয় কী : সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন চবির অধ্যাপক ড. মো. শফীকুল ইসলাম। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশি পরিমাণে বৃক্ষরোপণ, পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং অপরিকল্পিতভাবে খাল বিল ভরাট করে নগরায়ন না করা।
তিনি বলেন, প্রথমত, বেশি পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করলে জলবায়ুর ওপর পজেটিভ ইমপ্যাক্ট আসবে। বৃষ্টিপাত বেশি হবে, তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খাল বিল ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন বন্ধ করতে হবে। এতে খালবিল ও ফাঁকা জায়গাতে সারফেস ওয়াটার বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যাবে। এটা একদিকে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করবে, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপরে ওঠাতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, পাহাড় কাটা বন্ধ রাখলে পরিবেশেও ওপর পজেটিভ ইমপ্যাক্ট রাখবে। এছাড়া সমস্যাগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। তাহলে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এটা শুধু কক্সবাজার নয়, ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোর জন্যও প্রযোজ্য।