কক্সবাজারে ইতিহাস, স্বপ্নপূরণ

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ও আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন টিকেট কেটে ট্রেনে চড়ে রামু যান প্রধানমন্ত্রী 'কক্সবাজারবাসীর জন্য আনন্দের দিন'

কক্সবাজার প্রতিনিধি | রবিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে কক্সবাজারের মানুষও স্বপ্ন দেখেছিল রেলের। অবশেষে রেল এলো পর্যটননগরী কক্সবাজারে। অবসান ঘটল শত বছরের অপেক্ষার। পূরণ হলো ১৩৩ বছরের স্বপ্ন। গতকাল শনিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে নবনির্মিত কক্সবাজারদোহাজারী ১০২ কিলোমিটার রেললাইন এবং ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন করলেন। গড়লেন নতুন ইতিহাস।

উদ্বোধনী বক্তৃতা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজ কক্সবাজারবাসীর জন্য একটি আনন্দের দিন, এখানে রেল যোগাযোগ স্থাপন হলো। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেসব বিরোধী দলীয় নেতার চোখে পড়ে না, তাদের ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমি জানি যে আমাদের বিরোধী দল, তারা আমাদের উন্নয়নটা চোখে দেখে না, এগুলো বলার কিছু নাই। চোখ থাকতে যারা অন্ধ হয় তাদের আর কী বলব। তাদের একটা পরামর্শ দিতে পারি, আমি কিন্তু ঢাকায় খুব আধুনিক আই ইনস্টিটিউট করেছি। চোখ থাকতেও যারা অন্ধ তারা সেই আধুনিক আই ইনস্টিটিউটে যেয়ে চোখটা দেখিয়ে আসতে পারেন। মাত্র ১০ টাকার টিকিট লাগে, বেশি লাগে না। আসলে তাদের চোখের দোষ না, মনের দোষ। এই রেললাইনের মাধ্যমে দেশের পর্যটনের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি আজকের দিনটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটা গর্বের দিন। রেল সংযোগ করতে পেরে সত্যিই আমি খুব আনন্দিত। আমি জানি, দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের মানুষের একটা দাবি ছিল। রেলে কক্সবাজার আসা যাবেএটা অনেকের আকাক্সক্ষা ছিল। আজকে আমরা সেটা করেছি, এটা হবে প্রথম মর্যাদার প্রকল্প।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যমুনা সেতুর উপর দিয়ে সড়কের সঙ্গে যেহেতু রেল করে দিয়েছি। আমরা চাই উত্তরবঙ্গ পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার, কক্সবাজার থেকেও পঞ্চগড় যেন রেলে আসতে পারে। সেই ব্যবস্থাটাও করতে হবে। সুন্দরবন থেকেও যেন কক্সবাজার আসতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে পারব।

তিনি বলেন, আমরা এখন অপেক্ষা করে থাকব, পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার অথবা রাজশাহী থেকে কক্সবাজার, আবার দক্ষিণ অঞ্চলের সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরই বাদ যাবে কেন? সমগ্র বাংলাদেশ থেকেই যেন আসা যায় সেই ব্যবস্থাটা আমরা নেব। কক্সবাজারবাসীকে আমরা বলব, আমাদের অঞ্চলেও যাবেন, বেড়াতে যাবেন, ঘুরতে যাবেন। আমি বিশ্বাস করি পর্যটন ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসবে।

তিনি বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে শুনতাম চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন ছিল, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেললাইন কবে আসবে? আজকে কক্সবাজার পর্যন্ত করা হয়েছে, এটা রামু পর্যন্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসতে চাই, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাথে আমরা সংযুক্ত হতে চাই। কাজেই সেটা মাথায় রেখে পরিকল্পনাটা নেওয়া হয়েছে।

রেলপথ ব্যবহারে যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ গত পনের বছরে বদলে গেছে। রেল থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট সবকিছুই কিন্তু উন্নয়ন করেছিলাম। রেলকে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি, যেন খুব অল্প খরচে সাধারণ মানুষ চলাফেরা করতে পারে। সেভাবে চিন্তা করেই রেলকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমি অনুরোধ করব, অত্যন্ত আধুনিক রেলস্টেশন করে দিয়েছি, যেন পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন থাকে। যেখানেসেখানে যত্রতত্র ময়লা না ফেলা, রেলস্টেশন যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। কোনো জিনিস যেন হাত দিয়ে নষ্ট না করে। নিজেদের আপন সম্পদ মনে করে যত্ন নিয়ে ব্যবহার করবেন।

বিরোধী দলের আন্দোলনে যানবাহনে আগুন দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই দুর্বৃত্ত, তাদের আসলে চোখ না, তাদের মনই অন্ধকার। কাজেই এদের ব্যাপারে সকলকে সাবধান থাকতে হবে। এরা ধ্বংস জানে, সৃষ্টি করতে পারে না। আমরা সৃষ্টি করি, ওরা ধ্বংস করে। কিন্তু এই ধ্বংস যেন করতে না পারে। মানুষকে পুড়িয়ে মারবেএটা সহ্য করা যায় না।

রেলসম্পদ একসময় অবহেলিত ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশটা আমাদের, দেশটাকে আমরা চিনি, আমরা জানি এর কী উন্নতি করতে হবে। ওই একজনদুজন বাইরে থেকে এসেই আমাদের উপর খবরদারি আর আমাদেরকে পরামর্শ দেবে, সেটা হয় না। রেলে ওয়াইফাই দিয়ে দেব, রেলে বসে বসে যাতে কাজ করতে পারে। এই রেলসম্পদ অবহেলিত ছিল। আমরা এসে দেখলাম অনেকগুলো রেললাইন বন্ধ, রেল স্টেশন বন্ধ। কারণ পদ্মা সেতুর অর্থ যখন বন্ধ করে দিয়েছিল, তাদেরই উপদেশ ছিল এই দেশে রেল চলবে না, রেল লাভজনক না। রেলে সাধারণ মানুষ চলে, সস্তায় পণ্য পরিবহন হয়, এই ক্ষেত্রে সবসময় লাভলোকসানের হিসাব করা যায় না, মানুষের সেবাটাই বড়।

মানুষের সেবার বিষয়টি বিবেচনা করেই সরকার কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যখনই কোনো কাজ করি আমরা সেটাই বিবেচনা করি, মানুষকে আমরা কতটা সেবা দিতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম রেলের আলাদা মন্ত্রণালয় করব, কারণ এটা ছিল সড়ক সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত। আলাদা মন্ত্রণালয় করে আলাদা বাজেট দেওয়া শুরু করলাম। সারা বাংলাদেশকে এই নেটওয়ার্কে নিয়ে আসলাম। পয়ষট্টি সালে ভারতপাকিস্তানের যুদ্ধ হয় সেই সময় বাংলাদেশ কিন্তু সম্পূর্ণ অরক্ষিতই ছিল। তার পরেও বাংলাদেশের সাথে রেলের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার ফলে আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, কক্সবাজারের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, রেলপথ মন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির, রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল হাসান, দোহাজারী কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণকাজের প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন জিন্টিং প্রমুখ।

প্রধানমন্ত্রীর ট্রেনযাত্রা : দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে নিজের হাতে টিকেট কেটে ট্রেনে উঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ১টা ২৫ মিনিটে সবুজ পতাকা নেড়ে এবং হুইসেল বাজিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই রুটে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করেন তিনি।

১টা ২৮ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে ট্রেনটি কক্সবাজার রেলস্টেশন থেকে রামু স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে ট্রেনটি রামু স্টেশনে পৌঁছায়। ট্রেনযাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ৩শ জন মানুষ। রেললাইনের দুই পাশে সুপারি বাগান, মাঠ ভরা ফসলের হাসি ও সবুজের বুক চিরে এগিয়ে চলে ট্রেন। পথে হাজারো মানুষের উল্লাস প্রকাশ করে। উৎসুক জনতা প্রধানমন্ত্রীকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। প্রধানমন্ত্রীও হাত নেড়ে তাদের অভ্যর্থনার জবাব দেন।

প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা রামু এলাকার বৃদ্ধ আবদুল করিম (৮৫) বলেন, ব্রিটিশ আমলে এখানে রেললাইন হওয়ার কথা ছিল। জরিপও হয়েছিল কয়েকবার। এ কথা আমরা দাদার মুখ থেকে শুনে আসছি। দাদার বাবারাও একই স্বপ্ন দেখত। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে দাদার বাবা মারা গেল, দাদা মারা গেল এবং বাবাও মারা গেল। আর শেষ বয়সে আমি নিজ চোখে ট্রেন দেখলাম। এ এক অন্যরকম আনন্দ, যা বলে বোঝানো যাবে না।

তবে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন হলেও বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। এদিকে রামু স্টেশন থেকে প্রধানমন্ত্রী যান রামু সেনানিবাসে। সেখান থেকে মাতারবাড়ি যাত্রা করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্রিটিশ ও পাকিস্তান পারল না, পারল বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধদাঁড়িয়ে থাকা ট্রাককে অপর ট্রাকের ধাক্কা, হেলপার নিহত