সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যেখানে উন্নত বা মান বৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেখানে আরো বিশৃঙ্খলা বেড়েছে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে! সমুদ্র সৈকত ও পর্যটনজোন কলাতলী ঘিরে বেড়েছে এসব বিশৃঙ্খলা। বিশেষ করে সমুদ্র সৈকত ঘিরে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে কয়েকগুণ। এই পরিস্থিতিতে পর্যটকদের অস্বস্তি ও বিরক্তি বেড়েছে– এমনটি জানান পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গণ–অভ্যুত্থানের পর পর্যটন জোনে বিভিন্ন হোটেল ও সৈকতের বালিয়াড়ির দোকান দখল–বেদখল, বালিয়াড়ি দখল করে নতুন করে যত্রতত্র ঝুপড়ি দোকান ও মাত্রাতিরিক্ত কিটকট বসানো এবং সৈকতে বেপরোয়া বিচ বাইকের উৎপাত বেড়েছে। সাথে রয়েছে, ছিনতাইকারীসহ নানা অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। আর যুক্ত হয়েছে চাঁদাবাজি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২৪ এর গণ–অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পালাবদলে দখল–বেদখল হয়েছে পর্যটনজোন কলাতলীর বহু মোটেল–হোটেল। একইভাবে সমুদ্র সৈকতের ঝুপড়ি দোকানের মার্কেটেও দোকান দখল–বেদখল হয়েছে। এই নিয়ে সংঘর্ষসহ নানা অঘটন ঘটেছে। একই সাথে ক্ষমতার পরিবর্তনে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। বালিয়াড়ি দখল করে অনিয়ন্ত্রিত ঝুপড়ি দোকান, কিটকট, বিচবাইক বসানো হয়েছে। এতে পর্যটকদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে বহু– যার প্রভাব পড়ছে পর্যটন শিল্পে।
জানা গেছে, নতুন করে সৈকতের বালিয়াড়িতে ৩০০ শতাধিক ঝুপড়ি দোকান অনুমোদন দিয়েছে জেলা প্রশাসন। একই সাথে নতুন করে কিটকট, বিচবাইক ও জেটস্কিও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সমপ্রতি দেয়া এসব অনুমোদন নিয়ে সৈকত এলাকায় উত্তপ্ত এবং মারমুখী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে নতুন অনুমোদিত ঝুপড়ি দোকান বসানো নিয়ে জেলা প্রশাসন ও বালিয়াড়ি দখলকারীদের মধ্যে সমপ্রতি মারমুখী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষাপটে দোকানগুলোর অনুমতি অঘোষিতভাবে স্থগিত রয়েছে। একই সাথে নতুন অনুমোদন দেয়া কিটকট নিয়েও উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। স্থানের চেয়ে বেশি সংখ্যক কিটকট অনুমোদন দেয়ায় স্থান নির্ধারণ নিয়ে সুবিধাভোগীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে– যা মারামারির পর্যায়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন জানিয়েছেন, প্রশাসন স্থান নির্ধারণ করে দেয়নি। এই সুযোগ নিয়ে আগের কিটকট সুবিধাভোগীরা নতুন সুবিধাভোগীদের স্থান দিচ্ছে না। এই নিয়ে পরিস্থিতি জটিল হলেও গা ছাড়া ভাব নিয়ে রয়েছে জেলা প্রশাসন। তাতে বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে রাতের আঁধারে বৈধ–অবৈধ মাত্রাতিরিক্ত কিটকট বসানো হয়েছে। বর্তমানে সৈকতের শৈবাল পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত পুরো স্থানজুড়ে বসোনা হয়েছে কিটকট। এমনকি নির্দিষ্ট স্থান ফাঁকা না রেখে একটার সাথে একটা প্রায়ই লাগিয়ে বসানো হয়েছে কিটকটগুলো। এতে বিব্রতকর ও অস্বস্তিতে পড়ছেন পর্যটকরা।
এ ব্যাপারে কুমিল্লা থেকে আসা ব্যবসায়ী আবদুল হালিম বলেন, ‘কিটকটগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে, নিজেদের কথার গোপনীয়তাও রক্ষা করা যায় না। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মন প্রসারিত করে সৈকতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় না।’
পর্যটকরা বলছেন, সৈকতে বিচবাইকগুলো বেপরোয়াভাবে চলাচল করে। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার আতঙ্কে থাকতে হয় পর্যটকদের। নিয়ম অমান্য করে জনকোলাহলপূর্ণ স্থানে বিচরণ করছে বাইকগুলো।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আমিনুল হক বলেন, ‘বিচবাইকগুলো চলাচল করে বেপরোয়াভাবে। আবার চালায় আনাড়ি পর্যটকরা। এতে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে প্রাণহানিসহ বড় দুর্ঘটনা। কিন্তু প্রশাসন এই নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’
শুধু এই পরিস্থিতি নয়; সাথে ছিনতাইকারী, হিজড়া, অনিয়ন্ত্রিত হকার এবং হোটেল বুকিং কেন্দ্রিক দালালের উৎপাত বেড়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ ও থানা পুলিশের নজরদারির মধ্যেও ঘটছে এসব অপরাধ।
সচেতন লোকজন বলছেন, কক্সবাজারের অপার সম্ভাবনার পর্যটন শিল্প নিয়ে প্রশাসনের কার্যক্রম ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে কোনো উদ্যোগ নেই। অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের উন্নতি না হয়ে মান নিম্নগামী হচ্ছে।
’২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের ছাত্রপ্রতিনিধি শাহেদ মোহাম্মদ লাদেন বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশে লুটপাট বন্ধ করে সুন্দর দেশ গড়ার অঙ্গীকার ছিলো। কিন্তু কক্সবাজারে সেটি দেখা যাচ্ছে না। এখানে লুটপাট চলছে, পর্যটন শিল্পকে লুটপাটের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতারা কেউই পর্যটন শিল্প নিয়ে ভাবছেন না বরং ক্ষতি করছেন।’
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.ন.ম হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প নিয়ে কোনো সময় যথাযথ পরিকল্পিত কার্যক্রম ছিলো না। এর মধ্যে গণ–অভ্যুত্থানের পর এই নগরীকে আরো বেশি ধ্বংস করা হচ্ছে। সৈকতকে বস্তি বানানোর মিশনে প্রশাসন ও কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। যে যেভাবে পারে লুটপাটে মেতে উঠেছে।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য নয়। আমার জানা মতে পর্যটনের পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। বালিয়াড়িতে দোকান বসানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য বিষয়েও আমাদের নজরদারি রয়েছে। এছাড়া যে কোনো বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং স্বস্তিদায়ক পরিবেশ বজায় রাখতে ট্যুরিস্ট পুলিশ বদ্ধপরিকর। সৈকতের পরিবেশ ও পর্যটকদের বিঘ্ন ঘটায় সমপ্রতি বসানো অনুমতিবিহীন ঝুপড়ি দোকান বসাতে আমরা বাধা দিয়েছে। ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপরাধীদের ধরতে আমরা রাতদিন কাজ করছি।